ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ, রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, বীর প্রতীক(অব.)

(২ সপ্তাহ আগে) ২৭ আগস্ট ২০২৪, মঙ্গলবার, ৬:২৭ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৬ পূর্বাহ্ন

mzamin

জাতির উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ অত্যন্ত সময় উপযোগী এবং অসাধারণ। এই দেশের ৫৩ বৎসরের আবর্জনা, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অবনতি, দালালীর স্বর্গরাজ্য, সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে পূর্ববর্তী সব ক’টি রাজনৈতিক সরকার এই দেশের অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে। মানুষের প্রত্যাশার প্রতি কোনো সরকারই গুরুত্ব না দিয়ে নিজ বাহিনীদের অপব্যবহার করে দেশ চালিয়েছে।  এরশাদের মতো ব্যক্তিরাও ৯ বৎসর এই দেশকে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিবস্ত্র করে অপব্যবহার করেছে। এখন যাদের বয়স ৫৩ বৎসর তারা সবাই নিরবে সহ্য করেছে এই স্বৈরাচারী শাসন। আমার মতো ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর সাথে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে দীর্ঘদিন এই দেশের সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে যে ধারণা হয়েছে, তা উপরের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন নিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি বিগত দিনগুলিতে। আশা ছাড়ি নাই। ১১ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে এম আর চৌধুরী স্টেডিয়ামে স্বাধীন দেশের প্রথম সেনা অফিসারদের পাসিং আউট প্যারেডে অংশগ্রহণ করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি এবং রিভিউইং অফিসার হিসেবে অলিখিত বক্তব্য যা ইউটিউবে ১১ জানুয়ারি –শেখ মুজিব বক্তৃতা–হিসেবে পাওয়া যায়। তা ছিল তার ৩ বৎসরের সরকারের একটি প্রামাণ্য চিত্র। তার বক্তৃতার বিষয়বস্তু আমাকে নতুন কর্ম জীবনের দিক নির্দেশনা দেয়। তার  বক্তৃতায় স্পষ্ট ছিল যে রাজনৈতিক দলের নীতিভ্রষ্ট  কর্মতৎপরতা নতুন দেশের জন্য কতটুকু ভয়াবহ। এই ৫৩ বৎসরের সরকারগুলির কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে বর্ণনা করলে মোটামুটি একটি বই লেখা যাবে। আজ শুধু বর্তমান  পরিস্থিতিতে কিছু বক্তব্য পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করব। দীর্ঘ ১৬ বৎসর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার-এর স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র, দেশকে টয়লেট পেপারের মত ব্যবহার, বিরোধী রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, পুলিশ, বিজিবি, সরকারি কর্মচারী এবং দেশের সেনাবাহিনীসহ সকল প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সাহায্য জিম্মি করে রাখে। 

ক্ষমতার স্বার্থে দেশকে জলাঞ্জলি দিয়ে গণতন্ত্র হত্যা করে নিজ মাফিয়া গোষ্ঠীকে অভাবনীয় সুযোগ/সুবিধা, শেয়ার বাজার লুট, ব্যবসা বাণিজ্যে চাঁদা/কমিশন, সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নিজ চাটুকারদের নিয়োগের মাধ্যমে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে আসে।
দেশের কোন ব্যক্তি/গোষ্ঠী তার প্রতিবাদ করলে গুম, খুন, হাজত এবং অভিনব উপায়ে আয়না ঘরে মাটির নীচে ছোট্ট সেলে দীর্ঘদিন আটকে রাখাসহ অমানবিক অপকর্ম সকল সীমা লঙ্ঘন করে। এ দেশের আবাল, বৃদ্ধ বনিতা সবাই আল্লাহ এর নিকট মুক্তি চেয়ে প্রার্থনা করে। এই অনুভূতি মাঝে মধ্যে আমরা সরকারি গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সংগঠনের নিকট উপস্থাপন করলেও তারা আমাদের বিএনপি/জামাত আখ্যা দিয়ে বিষয়টি হালকা করে কোনো মুল্যায়ন করে নাই। আওয়ামী লীগে ২০১০ থেকে বঙ্গবন্ধুর ১০০ বৎসর পূর্তী উপলক্ষে রাস্তা-ঘাটে মূর্তি, এলইডি টিভিতে ৭ই মার্চের ভাষণ, রাস্তা-ঘাটে অগণিত বিলবোর্ড দেখে সবাই বিরক্ত। আমি বলেছিলাম ১০০ বৎসর পূর্তিতে আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের পরিণতি হতে পারে। অনেকেই আমার এই বক্তব্যকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেন। গত ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে ছাত্র জনতার বিপ্লব স্বৈরাচারীর সকল ব্যবস্থা উৎখাত করে। বিশ্বের বিশিষ্ট রাষ্ট্র নায়ক, ৪৫ মিনিটের ভিতরে দেশ ত্যাগ না করলে গণভবনে হয়তো অন্যরকম পরিস্থিতি হতো। দেশে আরও অনেক রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটতে পারত।  এই বিপ্লবে ১০০০ এর অধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হয় এবং ১৫,০০০ এর বেশি আহত হয়। সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। তাদের সংগঠনিক পেশাদারিত্ব, কর্মতৎপরতা এই দেশের ক্রান্তিলগ্নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সেনাবাহিনী প্রধানের দূরদর্শীতা এবং ব্যবস্থাপনা প্রশংসার দাবি রাখে। দেশে সম্ভাব্য বিরাট মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে দেশকে রক্ষা করেন। অভিযুক্ত এমপি, মন্ত্রীদের সেনানিবাসে আশ্রয় দিয়ে এক রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি থেকে দেশের ও জাতির সুনাম রক্ষা করে। সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার পক্ষ নেয় এবং দেশের মানুষের আস্থা ফিরে পায়। 

আমাদের প্রধান উপদেষ্টা গত ২৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি সঠিকভাবে বলেছেন, তার সরকার বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক নিয়োজিত। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এই ধ্রুব সত্যটা জাতির নিকট উপস্থাপিত করার জন্য। ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখ ছাত্র-জনতা যে ইতিহাস রচনা করেছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের স্বাধীনতার ফসল এবং নতুন স্বাধীনতাও বটে। আমি এই বিপ্লবে আত্মদানকারী এবং আহত সবাইকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও কৃতজ্ঞতার সহিত দেশের বীরদের মর্যাদায় দেখতে চাই। তাদের অবদান এবং এই আয়না ঘরে আটকে রাখা জাতিকে মুক্ত করার কৃতিত্বে আগামী ১০০ বৎসর তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। সাবাস বিপ্লবী ছাত্র-জনতা, সাবাস নতুন প্রজন্ম তোমরা বিশ্বের বিস্ময়। একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি তোমাদের কাছে চিরঋণী। আমার জীবদ্দশায় এই আনন্দ এবং মুক্ত বাতাসে বিচরণ আমার মুক্তি যুদ্ধের  স্বার্থকতা।
এখন বলতে চাই গণতন্ত্র কখন মুক্তি পাবে? যত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তবে সময়টা আমাদের প্রধান উপদেষ্টা, ছাত্র-জনতা, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং দেশের মানুষের কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। তাহলে কবে, কখন, কিভাবে এই দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণ গণতন্ত্র কবে পাব? অন্তর্বতীকালীন সরকার তো দায়িত্বটা জনগণের উপর ছেড়ে দিল। 
তা হলে এখন জনগণের দায়িত্ব কি? জনগণ মানেই রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ছাত্র জনতা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে প্রধান অংশীদার ছাত্রদের প্রতিনিধিসহ সবাই এক সাথে বসে ঠিক করতে হবে। এই অন্তর্র্বতী সরকারের নিকট কি কি তারা আশা করেন। কিভাবে তা করা যাবে তার সমাধানসহ সুপারিশ উপস্থাপন করা। কতদিন প্রয়োজন ঠিক করে দেবে। 


দেশ, জাতী ও ছাত্র-জনতা সবাই সংস্কার চায়। কি সংস্কার? আসলে আমাদের দেশে ব্রিটিশ ও স্বৈরাচার কর্তৃক যে সকল অমানবিক প্রথা এবং আইন সংশোধনী, প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার নামই সংস্কার। এখন সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নিয়ে সেমিনার, আলোচনা সভার মত অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। নির্বাচন, সরকারের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ কিভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন সকল স্তরে বাস্তবায়ন করা যায় তার যথাযথ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই  আলোচনায় অনেকগুলি বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রস্তাব উপস্থাপন এবং তা আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দরকার। বর্তমানে সরকার পরিবর্তন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এখন মাঠে বিএনপি’ই প্রধান রাজনৈতিক দল। তা হলে বিএনপি’র দায়িত্ব হবে সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসা এবং একটি কার্যকর ব্যবস্থা বা সুপারিশ নিয়ে এক সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সাহায্য করা। এ বিষয়ে বিএনপি যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে। তবে এই বিষয়ে কার্যকরী ভুমিকা রাখার জন্য জনাব তারেক রহমানকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমার মনে হয় তারেক রহমানেরও মানসিক প্রস্তুতি আছে এই ধরনের কাজে ভূমিকা রাখার। তাঁর সম্প্রতিকালের বক্তব্যে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে বলে প্রতীয়মান হয়। আসুন আমরা আমাদের এই রক্তাক্ত অর্জন স্থায়ী করার লক্ষ্যে সবাই মিলে কাজ করি এবং সত্যিকারের সংস্কার করে জনগণের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করি।
আমাদের দেশে নোবেল বিজয়ী এই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব যা আমাদের এই মুহূর্তের জন্য সঠিক নেতৃত্ব। বহিঃবিশ্বে  তার সুনাম এবং পরিচিতি বর্তমানে আমাদের জন্য এক “আয়রণ কার্টেন” হিসেবে বিবেচ্য। আমরা ভাগ্যবান জাতি যে এ ধরনের একজন নেতৃত্ব আমাদের এই মূহূর্তে দেশের হাল ধরেছেন। অন্যান্য যারা এই উপদেষ্টা পরিষদে আছেন, তাদের সবাই অত্যন্ত দেশ প্রেমিক, সৎ এবং নিষ্ঠাবান। আমি আশা করব আমরা সবাই ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের সাহায্য করব এবং প্রয়োজনীয় সময় দেব। কমপক্ষে ৫৩ বৎসরের আবর্জনা পরিস্কার করতে ৫৩ সপ্তাহ কাজ করতে দিন। আপনাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, দাবী-দাওয়া সব কিছুর প্রতি এই সরকার সহানুভূতিশীল। পরবর্তীতে দীর্ঘ মেয়াদী একটি গণতান্ত্রিক সরকারদের জন্য আপনাদের দাবী-দাওয়া প্রস্তুত করেন। দলমত নির্বিশেষে এই সংগ্রাম, স্বাধিকার আদায়ের বিপ্লবকে ফলপ্রসু করার কাজ  করুন। আমরা সবাই বিবাদ ভুলে গিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।

 

লেখক:  কর্ণেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, বীর প্রতীক

একজন খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status