ঢাকা, ৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৬ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

মত-মতান্তর

বাংলাদেশে ফার্মেসির বিস্ফোরণ এবং একটি লুকানো স্বাস্থ্য সংকট

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার

(২৩ ঘন্টা আগে) ২ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১০:৪২ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৬:৩৩ অপরাহ্ন

mzamin

আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে নতুন ফার্মেসির উত্থান জনগণের জন্য ওষুধের সহজপ্রাপ্যতার পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই দৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর স্বাস্থ্য সংকট, যা দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অসংখ্য ফার্মেসির বেপরোয়া বিস্তার, যার অনেকগুলোরই সঠিক লাইসেন্স বা প্রশিক্ষিত কর্মী নেই, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অতিরিক্ত ওষুধের ব্যবহার ও ঝুঁকিপূর্ণ স্ব-চিকিৎসাকে ভয়াবহভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আনুমানিক ১,৭৩,৫০০টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি রয়েছে। তবে এর বাইরেও প্রায় ১,০০,০০০ অবৈধ ফার্মেসি দেশে খোলামেলাভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে, এই লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসিগুলোর মধ্যে মাত্র ৩০০টির মতো ‘মডেল ফার্মেসি’ মানদণ্ডে উন্নীত, যেখানে প্রশিক্ষিত কর্মী ও যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বাকি বিপুল সংখ্যক ফার্মেসি পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যাচ্ছে, যেখানে কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অবলীলায় শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক, সেডেটিভ ও ইনজেকশন বিক্রি হচ্ছে। ওষুধ এখন চিকিৎসার মাধ্যম নয়, বরং একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে।

এর পরিণাম ভয়াবহ। ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ ব্যক্তিগতভাবে জনগণকে বহন করতে হয়েছে, যা ২০২০ সালের ৬৮.৫ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই ব্যক্তিগত ব্যয়ের মধ্যে ওষুধ ক্রয়ের অংশ ৫৪ শতাংশেরও বেশি। শুধু ২০২২ সালেই চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে ৬.১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩.৭ শতাংশ।

এই সংকটের মূল কারণ হলো: ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির আগ্রাসী বিপণন কৌশল, যা ডাক্তার ও ফার্মেসিগুলোকে নগদ টাকা, উপহার, এমনকি পরিবারসহ বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দিয়ে বেশি দামে বেশি ওষুধ বিক্রি করতে উৎসাহিত করে। ফলাফল হিসেবে, রোগীদের অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় দামি ব্র্যান্ডের ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হয়, যেখানে একই কার্যকারিতা সম্পন্ন কম দামের জেনেরিক ওষুধ পাওয়া যেত। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপক অপব্যবহার ইতোমধ্যেই দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ভয়াবহ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে—যা এক সময় সাধারণ সংক্রমণকেও অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে পারে।

এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ওষুধ কিনতে গিয়ে অনেক পরিবারকে সম্পদ বিক্রি করতে হয়, উচ্চ সুদের ঋণ নিতে হয় বা খাওয়া-দাওয়া এবং শিশুদের শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা বিসর্জন দিতে হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবারগুলোর জন্য চিকিৎসা ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তাদেরকে পরিবহন ব্যয় ও অনানুষ্ঠানিক ঘুষও বহন করতে হয়।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার কারণেই এই দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে উঠেছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রতি বছর ৪০ শতাংশেরও কম ফার্মেসি পরিদর্শন করে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। ফার্মেসির লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া জটিল, অস্বচ্ছ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বলে পরিচিত, যার ফলে নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা ওষুধ বাজারে ঢুকে পড়ছে।

এর সামাজিক মূল্য ভয়াবহ। অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বাড়ছে, স্ব-চিকিৎসার কারণে ভুল রোগ নির্ণয় এবং ওষুধের পারস্পরিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত হাসপাতালে ভর্তি বাড়ছে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভরে যাচ্ছে এবং মানুষের আস্থা ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে।

এটি শুধু স্বাস্থ্য খাতের নয়, এটি গভীর শাসন ব্যর্থতার একটি প্রতিফলন। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বর্তমানে দেশের মোট ওষুধের ৯৮ শতাংশ নিজস্ব উৎপাদন করে এবং ২০২৫ সালের শুরুর দিকে ১৩০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি অর্জন করেছে। এখন এই শিল্প একটি সঙ্কটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এটি চাইলে দেশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার একটি প্রধান শক্তি হতে পারে, নতুবা স্বাস্থ্য বৈষম্য ও আর্থিক ক্ষতির উৎস হয়ে উঠতে পারে।

এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে অবশ্যই ফার্মেসির লাইসেন্স কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে এবং ফার্মেসিগুলোতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিশ্চিত করতে হবে। ‘মডেল ফার্মেসি’কে ব্যতিক্রম নয়, বরং দেশের মানদণ্ডে পরিণত করতে হবে। প্রেসক্রিপশন পদ্ধতিকে স্বচ্ছ করতে হবে, উপহার বা আর্থিক প্রণোদনার বিনিময়ে প্রেসক্রিপশন নিষিদ্ধ করতে হবে এবং ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা চালু করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে যাতে সাধারণ জনগণের জন্য ওষুধের ব্যয় সহনীয় হয়।

সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দিতে একটি শক্তিশালী সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য খরচে আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও সক্ষমতা প্রদান করতে হবে যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ওষুধ সরবরাহ করা যায় এবং বেসরকারি ফার্মেসির উপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়।

বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের যে স্বপ্ন দেখছে, তা কখনই বাস্তবায়ন হবে না যদি ওষুধের খরচ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। তবে এই পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব। দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের উদ্ভাবন ও দেশীয় মূল্য সংযোজনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিক নিয়ন্ত্রণ, নৈতিক ব্যবসা এবং জনগণের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রণোদনার মাধ্যমে এই খাতটি লাভের জন্য নয়, বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষার শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

আমরা এখন একটি নির্ধারণমূলক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। আমরা কি ঔষধনির্ভর ঋণ, দুর্ভোগ এবং প্রতিরোধযোগ্য রোগব্যাধিকে চলতে দেব? নাকি আমরা এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলব যেখানে ফার্মেসি নিরাময়ের স্থান, ডাক্তাররা দায়িত্বশীল প্রেসক্রিপশন দেবেন এবং প্রতিটি নাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে স্বাস্থ্যসেবা পাবেন?

আজকের পদক্ষেপই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

 

লেখক- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক উর্ধ্বতন ষাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ

পাঠকের মতামত

কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অবলীলায় শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক, সেডেটিভ ও ইনজেকশন বিক্রি হচ্ছে। এর পরিণাম ভয়াবহ।

Mohsin
২ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ৩:০২ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status