ঢাকা, ২৫ মে ২০২৫, রবিবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৬ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

সংস্কার কী এবং কীভাবে?

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার, খালিদ সাইফুল্লাহ

(১ দিন আগে) ২৪ মে ২০২৫, শনিবার, ১০:২৫ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৫:৪১ অপরাহ্ন

একটা শব্দ বারবার উচ্চারণ করতে থাকলে একসময় সেটার অর্থ হারিয়ে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে ‘সেম্যান্টিক সেশিয়েশন’ বলে থাকেন। গত দেড় দশকে ‘উন্নয়ন’ আর ‘চেতনা’ শব্দ দুটোর এই পরিণতি হয়েছিল। বর্তমানে ‘সংস্কার’ শব্দটি এই ঝুঁকিতে আছে।

সংস্কার বলতে আমরা আসলে কি বুঝি? অন্ততঃ এতটুকু পরিস্কার যে সংস্কার মানে কল্যাণমুখী পরিবর্তন এবং এটি একটি চলমান (সুতরাং, অন্তহীন) প্রক্রিয়া। আমাদের প্রেক্ষাপটের জন্য নির্দিষ্ট করে বললে আমাদের কাঙ্খিত সংস্কার হচ্ছে সেইসব রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন যা গণতন্ত্রকে সুসংহত এবং কর্তৃত্ববাদকে প্রতিহত করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা অর্জনের উপায় কী?

এর জন্য আমাদের আগে বুঝতে হবে যে টেকসই, শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশগুলো এবং অগণতান্ত্রিক বা ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দেশগুলোর মধ্যে মূল পার্থক্য কোথায়। এক্ষেত্রে ২০১৯-এর যুক্তরাষ্ট্রের একটা দ্বিদলীয় উদ্যোগের কথা উল্লেখযোগ্য যার নাম দেয়া হয়েছিলো ‘ট্র্যানজিশন ইন্টেগ্রিটি প্রোজেক্ট’ বা টিআইপি। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনের আগে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো যে, ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গেলে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং ফলাফল প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। সেই প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগের মাধ্যমে শতাধিক বিশেষজ্ঞকে এক জায়গায় করে বিভিন্ন রাজনৈতিক সিনারিও বিচারপূর্বক ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া, তথা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী কী উপায়ে ভেঙে পড়তে পারে সেটা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান ও আইন বিষয়ের শীর্ষ বিশেষজ্ঞরা এই প্রকল্পে অংশ নেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে বেশ শক্তপোক্ত বলেই মনে করা হয়। অথচ টিআইপি-র বিশ্লেষণ মতে বহু ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে দেশটির গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত হতে পারে। সংবিধান বা আইন দিয়ে কখনোই গণতন্ত্রকে নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব নয়। তাহলে কোনো কোনো দেশে গণতন্ত্র যুগের পর যুগ, এমনকি শতাব্দীকাল টিকে থাকে কীভাবে? বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ গণতন্ত্র তাদের ‘অভ্যাস’। এইজন্যই গণতন্ত্রের ‘চর্চা’ করতে বলা হয়। চর্চার ফলে গণতন্ত্রের অভ্যাস তৈরি হয়, আবার অভ্যাসের কারণেই গণতন্ত্রের চর্চা টিকে থাকে।

আমেরিকার ২০২০ নির্বাচনের পর দেখা গেলো ঠিক তাই। ট্রাম্প বহু চেষ্টা করেও ক্ষমতায় থেকে যেতে পারলেন না। জনগণ, প্রতিষ্ঠান, এমনকি তার নিজের দল এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স-এর গণতন্ত্রের অভ্যাসের কারণে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো।

বাংলাদেশের জন্যও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এই গণতান্ত্রিক অভ্যাস তৈরি করা। সংবিধান, সংসদ বা নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার এখানে কেবলই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে, গণতান্ত্রিক চর্চার একটা সুবর্ণ সুযোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যেই অপচয় করেছে। সংস্কারের রুপরেখা তৈরি করার দায়িত্ব অন্তর্বতীকালীন সরকারের নিজের নেয়াটা একটা ভুল পদক্ষেপ ছিল। এই দায়িত্বটা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেয়া উচিত ছিল। এখানে সরকারের ভূমিকা হতে পারতো অভ্যুত্থানের আকাঙ্খা সংস্কারের রুপরেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা সেটা দেখা এবং সে ব্যাপারে দর কষাকষি করা।

এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের প্রতি ওউনারশীপ বা মালিকানা তৈরি করা সম্ভব ছিল। এটা গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সংস্কারকে টেকসই করতে সাহায্য করতে পারতো। প্রস্তাবগুলো সম্পূর্ণভাবে তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে হাজির করার ফলে এখানে কিছুটা রশি টানাটানির পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে যে, জোর করে টেকসই সংস্কার করা সম্ভব নয়।

দীর্ঘমেয়াদে বিচার করলে, টেকসই সংস্কারের পূর্বশর্ত শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি বা অভ্যাস তৈরি করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারব যে, সুশাসনের ব্যাপারটা আসলে একটা লেনদেন বা ট্র্যানজ্যাকশন। এখানে জনগণ রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ করে দেয় আর সরকার বিনিময়ে দেয় সুশাসন। সরকার এতে ব্যর্থ হলে জনগণ ওই ভোটের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন করে। বাংলাদেশে সরকারের সংস্কারমুখী হওয়ার প্রণোদনা তৈরি হবে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সময় পর পর জনগণের রায়ের মুখোমুখি হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে।

তাই এই মুহূর্তে আমাদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা। এই দুটাকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো সংস্কার সম্ভব নয়। বরং অন্য যেকোনো সংস্কার এটার ধারাবাহিকতায়ই আসবে।

 

  •  ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা 
    বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং প্রাক্তন বিশ্ব ব্যাংক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
  • খালিদ সাইফুল্লাহ
    রিসার্চ ফেলো, সেভ বাংলাদেশ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 

পাঠকের মতামত

সংস্কার একটি সোনার হরিণ

জনতার আদালত
২৪ মে ২০২৫, শনিবার, ১২:১৩ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status