ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে কয়েকটি সুপারিশ

আশরাফ উদ দৌলা

(১ মাস আগে) ১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ৯:২১ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৫:১২ অপরাহ্ন

mzamin

সংবিধানকে যেকোনো দেশের একটি 'পবিত্র দলিল' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা সেই দেশের  আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক চরিত্রকে প্রতিফলিত করে এবং শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি নাগরিকদের মৌলিক, অলঙ্ঘনীয় অধিকার এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি জাতির প্রতিশ্রুতির প্রমাণ হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। দুঃখের বিষয়, সংবিধানের সূচনাকাল থেকেই এটি জনগণের অধিকার এবং নিজের পবিত্রতা উভয়ই রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশ  হিসেবে আমাদের যাত্রার শুরু থেকেই, স্বতন্ত্র নেতাদের কর্তৃত্ববাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করতে এই সংবিধান বারবার সংশোধন ও বিকৃতির শিকার হয়েছে।

দুঃখজনকভাবে, সংবিধানকে অবমূল্যায়ন করার এই প্রক্রিয়া বঙ্গবন্ধুকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন তাঁর নিষ্ঠুর কন্যা হাসিনা, যিনি তার শাসনকে সুরক্ষিত করার জন্য সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে বাদ দিয়েছিলেন। নাগরিকরা, হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের শিকার হয়েছেন। সৌভাগ্যবশত এই অত্যাচারী শক্তি এখন বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং হাসিনা তার বিদেশি সমর্থকদের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। বাংলাদেশের নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার (আইজি), নাগরিকদের বৃহত্তর দাবিতে সাড়া দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্খার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংবিধানসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অপরিবর্তনীয় আইন তৈরি করা যা সংবিধানের কারসাজির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করবে।

এই পরিস্থিতিতে, আমি নবগঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটির বিবেচনার জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো প্রস্তাব করতে চাই:

১. সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব:  রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্বিশেষে সমাজের সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের একটি ব্যবস্থা চালু করা উচিত।

২. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ: বাংলাদেশের উচিত সংসদে দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বিবেচনা করা। নিম্ন কক্ষটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে, যখন উচ্চকক্ষ সমাজের বিভিন্ন স্তরের  প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হতে পারে, যেমন সশস্ত্র বাহিনী, একাডেমিয়া, ব্যবসা এবং পেশাদাররা। নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণ হওয়া উচিত এবং উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা নিম্নকক্ষের এক-তৃতীয়াংশে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। সংসদীয় মেয়াদ চার বছরের জন্য সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত।

৩. শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ: যেহেতু জুলাই-আগস্টের বিদ্রোহ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার জন্য একটি উদ্ভাবনী মডেল চালু করা উচিত। এটি একটি স্বাধীন ছাত্র সংসদের রূপ নিতে পারে, যা মূল সংসদে জমা পড়ার আগে ছাত্রদের মতামত ও আকাঙ্ক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন আইন পর্যালোচনা এবং ফিল্টার করবে। এই ত্রিভুজাকার কমিটি উভয় কক্ষের সদস্যদের নিয়ে প্রস্তাবিত আইন পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করতে পারে।

৪. সংশোধনী প্রক্রিয়া: সংবিধানের যেকোনো সংশোধনের জন্য প্রেসিডেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং সংসদের সকল শাখাকে সম্পৃক্ত করে একটি জাতীয় গণভোট অনুসরণ করে আরও কঠোর প্রক্রিয়া প্রয়োজন।

৫. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সীমা: প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত, প্রতিটি মেয়াদ চার বছরের বেশি স্থায়ী হবে না-এটি দীর্ঘদিনের দাবি।

৬. পারিবারিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা : প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকালে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের কোনো সরকারি বা রাজনৈতিক পদে থাকা নিষিদ্ধ করা উচিত।

৭. ন্যায়পাল: সরকারি কাজে তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ন্যায়পালের একটি সাংবিধানিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা উচিত।

৮. প্রাদেশিক শাসন: বর্ধিত ক্ষমতাসহ দেশের প্রশাসনিক বিভাগগুলোকে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দেবার কথা বিবেচনা করতে হবে। এর প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার মধ্যে রয়েছে - আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অভ্যন্তরীণ অভিবাসন হ্রাস। এর জেরে রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ ও যানজট নিরসন হবে।

৯. সম্ভাব্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান এড়াতে প্রেসিডেন্ট  ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে হবে।

আমার কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব ছেড়ে যাবার আগে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সংস্কার করে জাতিকে পুনর্গঠনের কাজটি সম্পূর্ণ করতে বদ্ধপরিকর। তিনি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। এমনকি আমরা ডক্টর ইউনূসের জন্য একটি বিশিষ্ট পদ প্রবর্তন করার কথাও বিবেচনা করতে পারি, যেমন ‘মন্ত্রীদের মেন্টর’ বা ‘মন্ত্রীদের অভিভাবক’। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউ যখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ত্যাগ করেন তখন তাঁর জন্য অনুরূপ পদ প্রবর্তন করা হয়েছিল। এটি একটি সাংবিধানিক পদ, যার দায়িত্ব থাকবে সরকার, তার কর্মীরা এবং সংসদ তাদের জাতীয় বাধ্যবাধকতার প্রতি যাতে দায়বদ্ধ থাকে তা নিশ্চিত করা ।

-লেখক আশরাফ উদ দৌলা সরকারের সাবেক সচিব এবং অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত

পাঠকের মতামত

Provincial govt is a must

Anonymous
২৬ অক্টোবর ২০২৪, শনিবার, ৭:২৬ পূর্বাহ্ন

প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিচারকরা, সংসদের সদস্যরা, পুলিশ মেজিষ্ট্রেটরা শিক্ষকরা সবাই যে যার ধর্ম অনুযায়ী কোরান গীতা বাইবেলের উপর হাত রেখে শপথ করবেন যে তারা কোন প্রকার অন্যায়কে প্রশয় দিবেন না, অন্যায় অবিচার করবেন না, ঘুষ নিবেন না, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন রকম ষড়যন্ত্র করবেন না।

বাঙালী
১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ৭:৩০ অপরাহ্ন

--রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে জনসাধারনকে গনতন্ত্রের উপর শিক্ষা দেয়া --যে সকল রাজনৈতিক দল সাধারন ভোটে ৫% এর কম ভোট পাবে তাদের রাজনৈতিক দল হিসাবে গন্য করা হবে না। --একই ব্যক্তি দুবারের বেশী প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রসিডেন্টের থাকতে পারবেন না --কাজের দিনে কোন রকম হরতাল অথবা ধর্মঘট করা চলবে না --হরতাল অথবা ধর্মঘটে নিরীহ লোকের জানমালের ক্ষতি হলে যে রাজনৈতিক দল হরতাল ডাকবে তাকে এর জন্য দায়ী করা হবে এবং সেই রাজনৈতিক দলকে ক্ষতিপুরন দিতে হবে --সুষ্ঠ এবং নিরেপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা --দুস্কৃতিকারী, ঘুষখোর, খুনি, ডাকাত, চান্দাবাজ, চোরাচালানকারী, মাস্তান, অসৎ লোকরা ভোটে দাড়াতে পারবে না --দুস্কৃতিকারী, ঘুষখোর, খুনি, ডাকাত, চান্দাবাজ, চোরাচালানকারী, মাস্তান, অসৎ লোকদের ছবিসহ পোষ্টার রাস্তায় রাস্তায় লাগিয়ে প্রচার করা --ভোটে দাড়াতে হলে প্রতিটি প্রার্থীকে চরিত্রের এবং শিক্ষার সার্টিফিকেট নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে --রাজনৈতিকদলগুলি নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে যে কোন সমস্যা সমাধনের চেষ্টা করবে। জার্মান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের বা তথ্যপ্রচারের স্বাধীনতা 1. Jede Person hat das Recht auf freie Meinungsäußerung. Dieses Recht schließt die Meinungsfreiheit und die Freiheit ein, Informationen und Ideen ohne behördliche Eingriffe und ohne Rücksicht auf Staatsgrenzen zu empfangen und weiterzugeben. যে কোন নাগরিকের তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দেশের এবং সীমান্তের বাইরের তথ্য এবং মুক্ত চিন্তাধারা গ্রহন এবং প্রচার করার স্বাধীনতা সংবাদপত্রের আছে। 2. Die Freiheit der Medien und ihre Pluralität werden geachtet. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের বহুত্ববাদকে সম্মান করা।

বাঙালী
১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ৩:৫০ অপরাহ্ন

ছাত্রদের সমন্বয়ে যে কমিটির কথা বলা হলো তা অবাস্তব ও অগ্রহনযোগ্য। এরকম করা হলে তখন উভয় কক্ষের প্রতিনিধিরা ঐ কমিটির তোয়াজে ব্যস্ত থাকবে। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবটিও ত্রুটিপূর্ন।

Eusuf Ali
১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ৩:৪৯ অপরাহ্ন

১০০% উত্তম প্রস্তাব। বাংলাদেশ এর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

IMRAN MURAD
১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ১:২৯ অপরাহ্ন

সহমত। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করে 'স্টুডেন্ট কেবিনেট' ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

আবু সাঈদ শুনু
১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status