ঢাকা, ২ জুন ২০২৫, সোমবার, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

তামাক কর কাঠামোর সংস্কার: জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও রাজস্ব বৃদ্ধির উপায়

অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী

(৬ দিন আগে) ২৭ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ৮:৫০ অপরাহ্ন

mzamin

বাংলাদেশে তামাকপণ্য যেমন সহজলভ্য, তেমনি এর কর কাঠামোও জটিল, ত্রুটিপূর্ণ এবং জনস্বাস্থ্যবিরোধী। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে তরুণ ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে মৃত্যু হচ্ছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৫৩ জন মানুষের। অথচ এখনো পর্যন্ত কার্যকর তামাক কর সংস্কার না হওয়ায় এই মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
তামাকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় অর্থনীতির ওপর একযোগে আঘাত হানছে। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮অর্থবছরে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাসে দেশের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বিপরীতে, একই সময়ে তামাক খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, রাজস্বের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি যা এক ভয়ংকর অসামঞ্জস্যের ইঙ্গিত দেয়।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (ঋঈঞঈ)-এ স্বাক্ষর করলেও এর ৬ নম্বর ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যকর কর ও মূল্য নীতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। দেশে বর্তমানে সিগারেটের চারটি মূল্যস্তর—নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম—এবং অ্যাড ভ্যালোরেম (মূল্যভিত্তিক) কর পদ্ধতি বহাল আছে, যা কোম্পানিগুলোকে সস্তা সিগারেট বাজারজাত করতে সহায়তা করছে। এতে তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, ২০০৬–০৭ সালে নিম্নস্তরের সিগারেটের বাজার শেয়ার ছিল ২৫ শতাংশ, যা ২০২০–২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশে। অর্থাৎ, সস্তা সিগারেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তো বাড়ছেই, পাশাপাশি সরকারও হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। যেমন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক প্যাকেট প্রিমিয়াম সিগারেট থেকে সরকার পেয়েছে ১২১.৫ টাকা, অথচ একই প্যাকেট নিম্নস্তরে ছিল মাত্র ৩৩.৩ টাকা।
অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে বহুগুণ, অথচ সিগারেটের দাম প্রায় স্থবির। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২৩ সময়ে চিনি, আলু ও আটার দাম যথাক্রমে ৮৯%, ৮৭% ও ৭৫% বেড়েছে। অথচ সিগারেটের দাম এই সময় বেড়েছে কেবল ৬ থেকে ১৫ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতির তুলনায় নিতান্তই কম। ফলে সিগারেট কার্যত আরও সস্তা হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, সঠিক করনীতির মাধ্যমে তামাক ব্যবহার কমানো এবং রাজস্ব বৃদ্ধি—উভয়ই সম্ভব। ফিলিপাইন ২০১২ সালে ‘ঝরহ ঞধী জবভড়ৎস অপঃ’ বাস্তবায়নের পর তিন বছরে সিগারেট বিক্রি কমেছে ২৮.১%, ধূমপানের হার ২৮.৩% থেকে নেমে এসেছে ২২.৭%-এ এবং রাজস্ব তিনগুণ বেড়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হলে ধূমপানের হার কমে এবং রাজস্ব আয় ৯ গুণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশেও এমন ইতিবাচক উদাহরণ আছে। চলতি বছরের শুরুতে সরকার সবধরনের সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ায়। এতে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬০% থেকে ৬৭% করা হয়। প্রিমিয়াম স্তরে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৫ টাকা এবং একই হারে শুল্ক আরোপ হয়।
এর ফলও মিলেছে হাতেনাতে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (ইঅঞ) জানায়, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে সিগারেট বিক্রি ৫৩৮ কোটি শলাকা কমলেও সরকার রাজস্ব পেয়েছে গত বছরের তুলনায় ৩২০ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ, কর বাড়ালে বিক্রি কমে—কিন্তু রাজস্ব বাড়ে।
এই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত তামাক কর সংস্কারে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিগারেটের নিম্ন ও মধ্যম স্তর একত্র করে খুচরা মূল্য ৯০ টাকা নির্ধারণ, উচ্চ স্তরের জন্য ১৪০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরে ১৯০ টাকা মূল্য নির্ধারণ—যেখানে ৬৭% সম্পূরক শুল্ক বজায় থাকবে। বিড়ির ক্ষেত্রে ফিল্টার ও নন-ফিল্টারের জন্য অভিন্ন ৪৫% শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে। গুল ও জর্দার মূল্য বাড়িয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৩০ টাকা নির্ধারণ এবং ৬০% শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া সব তামাকপণ্যের ওপর ১৫% মূসক এবং ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে তিনটি বড় সুফল পাওয়া যাবে। প্রথমত, প্রায় ২৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হবেন, ১৭ লাখ তরুণ তামাক শুরু করা থেকে বিরত থাকবেন। দ্বিতীয়ত, প্রায় ১৭ লাখ অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে, যা দেশের স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা যাবে।
তবে শুধু দাম বাড়ানো যথেষ্ট নয়। কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। যেমন, অ্যাড ভ্যালোরেম কর বাতিল করে সুনির্দিষ্ট কর কাঠামো চালু করা, মূল্যস্তর কমিয়ে একটিতে নামিয়ে আনা, ধোঁয়াবিহীন তামাকে উচ্চ কর আরোপ, তামাক রপ্তানিতে ২৫% শুল্ক পুনর্বহাল এবং একটি ৫ বছর মেয়াদি জাতীয় তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন।
তামাক কর বৃদ্ধি কেবল জনস্বাস্থ্য রক্ষার উপায় নয় এটি একটি জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন। এসডিজি অর্জন, স্বাস্থ্যব্যয় হ্রাস এবং একটি সুস্থ, উৎপাদনশীল প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে তামাক কর কাঠামো সংস্কার এখনই জরুরি। ২০২৫-২৬ সালের বাজেট হতে পারে সেই ঐতিহাসিক মাইলফলক যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করবে এবং জাতীয় রাজস্ব বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।


লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

পাঠকের মতামত

Stop 1 item, their will be 20 high power new items. Think carefully please.....

Shhhh
২৮ মে ২০২৫, বুধবার, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status