ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একজন ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

(১ দিন আগে) ৮ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৭ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫০ অপরাহ্ন

mzamin

বাংলাদেশের আইনের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, জ্ঞান আহরণ ও অধ্যবসায়ের এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ৪ঠা মে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪ টা ১০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি....রাজিউন। তার মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্ট এক উজ্জ্বল তারকাকে হারালো। জাতি হারালো তার এক আউটস্টেনডিং সিটিজেনকে। মহান আল্লাহ তায়ালা তার নেক আমলসমূহ কবুল করুন এবং মানুষ হিসেবে তার দোষ-ত্রুটিগুলো মার্জনা করে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক অসম্ভব ধরনের একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এমন মানুষের উপস্থিতি আমাদের দেশে, সমাজে ও সর্বোচ্চ আদালতে বিরল। তিনি ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব-কথায়, কাজে, বলনে ও চলনে। এক কথায় ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’। কথা বলতেন পরিশীলিতভাবে, গুছিয়ে ও তার সহজাত স্মার্ট ভঙ্গিমায়। তার কথা বা আলাপের শব্দচয়ন ছিল অসাধারণ। তার ব্যবহার ও আচরণে প্রজ্ঞা, বিনয় ও ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠতো। তিনি কাউকে আঘাত করে কথা বলতেন না। চিল্লাইয়া রগ খাড়া করে কথা বলা ছিল তার স্বভাব বিরোধী। তবে সত্য কথা যুক্তি দিয়ে জোরালোভাবে ভদ্রতার উচ্চমার্গে উঠে বলতে পারতেন অনায়াসে।

তার সাথে আমার পরিচয় ৩৬ বছরের, ১৯৮৯ সালে আমার লন্ডনে আসার কিছু দিনের মধ্যে তিনি লন্ডন সফরে আসলে তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশে জুনিয়র আইনজীবী, মাত্র ৩/৪ বছর পূর্বে ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে গেছেন। লন্ডনে আসলে তখন Inns of Court School of Law-এর Manual সবসময় ডাইরির মতো তার সঙ্গে থাকতো। সুযোগ পেলেই পড়তেন। কখনও অযথা সময় নষ্ট করতেন না। বরং সব সময় সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারই যেন তার সাধনা এমনটি বোঝা যেত। সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তরুণ আইনজীবীদের আইডল ছিলেন তিনি, সহজেই তাদের সঙ্গে ইন্টারেকশন করতে পারতেন।

এরপর যতবারই লন্ডন সফর করেছেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, নিদেনপক্ষে ফোনে কথা হয়েছে। একাধিকবার হিথ্রো এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করেছি অথবা সী অফ করেছি। লন্ডনে তাকে নিয়ে বহু সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেছি। বাংলাদেশে গেলেও সুপ্রিম কোর্টে অথবা তার নয়া পল্টনের সিটি হার্টস্থ চেম্বারে কথা হয়েছে, লম্বা আলাপ হয়েছে। ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষাতে বলার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ অধিবেশন পর্যবেক্ষণের জন্য তৎকালীন জনৈক মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করে তাৎক্ষণিক দুটি ভিআইপি টিকেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এক দশকেরও বেশি সময় লন্ডনে তার নির্বাসিত জীবনে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছে। তার স্নেহধন্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলাম আমি। তার নির্বাসিত জীবনে বিলেতে পুনর্বার লিগ্যাল প্রাকটিসে আসা, নতুন চেম্বারে যোগ দেয়া, অসুস্থতার সময় বৃটিশ জুরি সার্ভিসে ডাকা ও অব্যাহতি পাওয়া, পাওয়ার অব এটর্নি সংক্রান্ত জঠিলতাসহ নিজস্ব বহু ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতেন, আমার মতামত চাইতেন। আমি যখনই তার সান্নিধ্যে যেতাম তার ব্যতিক্রমধর্মী জিনিস লক্ষ্য করতাম। তিনি ছিলেন জ্ঞানের ভাণ্ডার। তাকে নিয়ে যে কত স্মৃতি! ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে তার চমৎকার sense of humour শুনেছি অনেকবার।

দীর্ঘ সময়ের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতায় কখনও তাকে অযথা কথা বলতে দেখিনি, দেখিনি কারো গিবত করতে। তার দৃশ্যত পরম শত্রুর ব্যাপারেও কথা বলতেন যথাযথ সম্মান দিয়ে। যেকোনো বিষয়ে যা আছে তা-ই বলতেন, বাড়িয়ে বলতেন না, কমিয়েও বলতেন না। তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল প্রখর। কোন বিষয়ে তার মতামত দিতেন অকাট্য যুক্তি দিয়ে ও যথাযথ রেফারেন্সর মাধ্যমে। যেকোনো জিনিস পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে করতেন, হোক সেটা কোর্টে শুনানি অথবা বিদেশিদের সাথে মিটিং বা সেমিনারে বক্তৃতা। তার মতো এমন আউটস্টেনডিং সিটিজেন এবং টাওয়ারিং ফিগার নিয়ে যেকোনো দেশ গর্ব করতে পারে।

বাংলাদেশের বহু যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক মামলা তিনি লড়েছেন, পরিচালনা করেছেন সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি সংক্রান্ত একুশে টিভির পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন মামলায় সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিজয়ী হওয়ার পর লন্ডন সফরে আসলে তাকে নিয়ে বাংলা মিডিয়ার সঙ্গে প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করি ২০০৪ সালের গোড়ার দিকে। ঐ মামলা ছিল এক যুগান্তকারী ঐতিহাসিক পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন মামলা, যাতে রাষ্ট্রশক্তির দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দৃশ্যমান ছিল। দেশের প্রথম সারির লিডিং আইনজীবীদের (ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইসতিয়াক আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক ও অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম প্রমুখ) হারিয়ে তিনি বিজয়ী হোন। ঐ মামলায় আইনি যুক্তিতে না পেরে সর্বোচ্চ আদালতের ফুল বেঞ্চে শুনানির এক পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন ব্যারিস্টার রাজ্জাককে অনেকটা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলেন “My Lords, Petitioners’ lawyer has ill political motive in this case.” শান্তশিষ্ট ও ঠান্ডা মাথার অধিকারী ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রাজ্জাক ব্যাঘ্রের মতো গর্জে উঠে জবাব দিলেন “Dr Kamal, hold your tongue” যা পরের দিন জাতীয় পত্রিকাগুলো হেডিং করে “ড. কামাল, জিহ্বা চেপে ধরুন-ব্যারিস্টার রাজ্জাক”! কোর্টে ঐদিন উভয় পক্ষের উপস্থিত আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপে শান্ত হয়।

বাংলাদেশে সফরে গেলে প্রায়ই প্রধান বিচারপতিসহ সিনিয়র বিচারপতি মহোদয়দের সঙ্গে সাক্ষাত হতো। সবার কাছ থেকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রশংসা শুনতাম। বিশ বছর আগে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালকে নিয়ে লন্ডনে একটি সেমিনার করি। উনাকে তার বাসা থেকে রিসিভ করে আনার প্রাক্কালে আলাপে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রশংসা করে এক পর্যায়ে বলেন “Many people don’t like Jammat but like him personally.” ২০০০ সালের দিকে একবার মনস্থ করেছিলাম বাংলাদেশে সেটেল্ড হয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করবো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করে কথা বললে তিনি বিনা সংকোচে রিকোমেন্ড করলেন ব্যারিস্টার রাজ্জাককে। বহু বিচারপতি ও আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সুনিপুণ এডভেকেসি ও কোর্টে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যতিক্রমধর্মী সাবমিশনের প্রশংসা করতেন। তার প্রশংসা শুনেছি ব্যারিস্টার মওদূদ আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো নেতৃস্থানীয় ও প্রতিথযশা আইনজীবীদের মুখে।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার আরেকটি দিক ছিল-ষাট দশকের শেষের দিকে ইসলামী ছাত্রসংঘ থেকে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ভিপি প্রার্থী ছিলেন। আমার মামা মরহুম সিরাজুল ইসলাম (বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ঐ সময় “ভিপি সিরাজ” নামে পরিচিত ছিলেন) ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিপি প্রার্থী হিসেবে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং নির্বাচনে বিজয়ী হোন। যখনই আমার দেখা হতো তার সমসাময়িক সহপাঠী আমার মামা ও তার পরিবারের খবরা-খবর নিতেন।

বিগত সরকারের হাতে নিষ্ঠুর জুলুমের শিকার হয়েছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। এক দশকের ওপরে লন্ডনে নির্বাসনে থাকতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও জনগণ বঞ্চিত হয় তার মতো কিংবদন্তির আইনি সেবা থেকে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসনে থাকতে আওয়ামী সরকারের ইশারায় তাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে দেয়নি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। অথচ এটি ছিল তার নূন্যতম মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। তিন তিন বার তাকে হাইকমিশন থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে তার পক্ষে রায় আসে। তারপরও সরকারের জুলুম থেকে তিনি রেহাই পাননি। তাকে এবং জনাব তারেক রহমানকেই মূলত উদ্দেশ্য করে হঠাৎ আচমকা এক নিয়ম চালু করলো তৎকালীন আওয়ামী সরকার যে পাওয়া অব এটর্নি দিতে বৈধ বাংলাদেশি পাসপোর্ট লাগবে। আবার তাদেরকে বাংলাদেশি পাসপোর্টও দেয়া হচ্ছিল না। এমন আজগুবি নিয়ম চালুর কারণে লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা পড়েছিলেন বিপাকে। যাক, ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের (আমি ও সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান) প্রচেষ্টায় এবং আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুলের তত্বাবধানে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সংক্রান্ত জটিলতার নিরসন হয়। লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা হাফ ছেড়ে বাঁচেন।

প্রত্যেক বনি আদমকে এই ধরা ছেড়ে যেতে হবে, আজ অথবা কাল। শতাব্দীর পরিক্রমায় আমরা যারা এই ধরায় এখন আছি তারা কেউই থাকবো না। তবে কিছু মানুষ বেঁচে থাকবেন তাদের কর্মে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক এমনই একজন মানুষ যিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে তার ব্যাতিক্রমধর্মী কর্মে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার। Email: [email protected]

পাঠকের মতামত

বাংলাদেশের আইনের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, জ্ঞান আহরণ ও অধ্যবসায়ের এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ৪ঠা মে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪ টা ১০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি....রাজিউন। তার মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্ট এক উজ্জ্বল তারকাকে হারালো। জাতি হারালো তার এক আউটস্টেনডিং সিটিজেনকে। মহান আল্লাহ তায়ালা তার নেক আমলসমূহ কবুল করুন এবং মানুষ হিসেবে তার দোষ-ত্রুটিগুলো মার্জনা করে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

আজাদ মান্নান
৮ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩ অপরাহ্ন

অসাধারণ ইনফোরমেটিভ প্রবন্ধ। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে !

আজাদ মান্নান
৮ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯:৪২ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status