ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

বাংলাদেশে পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার প্রধান কারণ ভারতের ড্যামবোর জলাশয় থেকে আসা ১২,৩০,০০,০০০ ঘনমিটার পানির ঢল

অধ্যাপক মোহাম্মদ সফি উল্যাহ

(১ সপ্তাহ আগে) ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭:৩২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৭:৩৩ অপরাহ্ন

mzamin

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আগস্টে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যায় এক বিশাল মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। ভারী বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি গত ২১ আগস্ট, ২০২৪ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ড্যামবোর বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের ১২টি জেলায় (ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং কক্সবাজার) ব্যাপক বন্যার কবলে পড়ে। এটি সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর মধ্যে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর এর অবস্থা খুবই খারাপ।

(১) এ বন্যার কারণে ৫ লক্ষ  পরিবারের মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা ঘরবাড়ি, জীবিকা এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে, যা প্রায় সমস্ত অঞ্চলে মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
(২) এই বন্যার প্রধান কারণ বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত এবং টানা বৃষ্টিপাত, পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পানি। ড্যামবোর বাঁধ খুলে দেওয়ার পরে ড্যামবোর বাঁধ থেকে আসা প্রায় ১২,৩০,০০,০০০ ঘনমিটার পানি (ড্যামবোর বাঁধের পেছনে প্রায় ৪১ বর্গকিমি এলাকা বিস্তৃত একটি হ্রদ রয়েছে এবং ড্যামবোর বাঁধের উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার।) এ অবস্থায়, ড্যাম খুলে দেয়ার পর হ্রদ থেকে বাংলাদেশে প্রায় ১২,৩০,০০,০০০ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়েছে। এই পানি বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূলীয় জেলার প্রায় ১৫০০ বর্গকিমি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলস্বরূপ, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে ওই দিন রাতেই পানির স্তর প্রায় ০.৮২ মিটার (বা ২.৭ ফুট) বেড়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের বন্যা প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে বাংলাদেশ আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে (জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়, ২৮ আগস্ট ২০২৪)। এছাড়া সিএনএন এর ২৯ আগস্ট বলেছে “ পানিকে অস্ত্র হিসেবে বব্যবহার করেছে ভারত” (সিএনএন ২৯ আগস্ট ২০২৪)।

(৩) অন্যদিকে, ভারতের ত্রিপুরার ড্যামবুর বাঁধ অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১৬০ মিটার। ঐ উচ্চতাথেকে বাংলাদেশে ফেনী পর্যন্ত নেমে এসে বর্ডারে এটি প্রায় ২০ মিটারে পৌঁছেছে। দুইটি জায়গা ছাড়া ফেণির ভূমিরূপ উচু থেকে নিচের দিকে নেমে এসছে। এরপর উপকূলীয় অঞ্চলে তা দুই থেকে এক মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে ১৬০ মিটার উচ্চতা থেকে পানি এসে নিম্নাঞ্চল কীভাবে প্লাবিত করেছে (চিত্র ১)। একই রকম চিত্র কুমিল্লার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কুমিল্লার ভূমিরূপ ১৫০ মিটার থেকে ১০ মিটারে এসে থেমেছে। দু-তিনটি জায়গায় এ ভূমিরূপ উঠানামা করেছে। কোথাও ১১০ মিটার কোথাও ৮০ মিটার এরূপ।

(৪) এছাড়া, ১৯৮০ দশকের পর থেকে পুরো বাংলাদেশে এবং দেশের পূর্বাঞ্চলে বিশেষকরে-  ফেনি, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন সিস্টেম প্রায় ১% করে প্রতি বছর কমে যাচ্ছে বিভিন্ন কারণে- যেমন ভূমি দখল ও অবৈধ নির্মাণ: অনেক অঞ্চলে খাল, নদী, এবং জলাভূমির উপরে অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের পথগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।নদীর পলি জমা: নদী ও খালগুলোতে পলি জমার ফলে গভীরতা কমে যাচ্ছে, যা বন্যার পানি সহজে নিষ্কাশন হতে বাধা দেয়।শিল্পায়ন ও নগরায়ণ: দ্রুতগতির শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে প্রাকৃতিক জলাধার ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাগুলো ধ্বংস হচ্ছে।পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব: প্রাকৃতিক নিষ্কাশন সিস্টেমের নিয়মিত পরিষ্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংস: বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে মাটির স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা প্রাকৃতিক নিষ্কাশন সিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করছে।পরিকল্পনার অভাবের: পরিকল্পনার অভাবে, ঘরবাড়ি নির্মাণ ও কৃষিজমি চাষাবাদে যথাযথ নীতি এবং পরিকল্পনার অভাব দেখা যাচ্ছে। এতে করে গ্রামাঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য পূর্ব-পরিকল্পনা না থাকায় কৃষিজমি বা জলাভূমির উপরে অবাধে নির্মাণ হচ্ছে, যা প্রাকৃতিক নিষ্কাশন সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

(৫) ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন সিস্টেমের অবনতি রোধ করতে হলে কিছু জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রথমত, অবৈধ দখল ও নির্মাণ বন্ধ করার জন্য শক্তিশালী আইন প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। নদী ও খালগুলোর পলি জমা কমানোর জন্য নিয়মিত পরিষ্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রক্রিয়া পরিকল্পিতভাবে করতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক জলাধার ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার ক্ষতি না হয়। বনাঞ্চল সংরক্ষণ এবং নতুন বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিতে হবে, যা মাটির ক্ষয় কমাতে সহায়তা করবে। গ্রামীণ পরিকল্পনার অভাব দূর করতে যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং কৃষিজমি ব্যবহারে সঠিক দিকনির্দেশনা থাকে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন সিস্টেম রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং বন্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যাবে।

লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত

By Nature Flood water goes downward. There are not enough people in Tripura who can drink 12,30,00,000 cubic meter of water to save Bangladesh from flood while Tripura itself was flooded and many people died.

Uchit Kotha
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, ৭:০৪ পূর্বাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status