শেষের পাতা
ভাঙাড়ি বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে
৩১ অক্টোবর ২০২৪, বৃহস্পতিবারদেলোয়ার হোসেন দেলো। খুলনার অলিগলিতে ঘুরে একসময় ভাঙাড়ি কিনে বিক্রি করতেন। এরপর ছিলেন নতুন বাজারে মাছের আড়তে ক্লিনার। শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলের আশীর্বাদে শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার রয়েছে মাছের কোম্পানি, পণ্যবাহী জাহাজ, একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি। কী- না করেছেন তিনি- কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট, জমি দখল, সুন্দরবনের ডাকাতদল নিয়ন্ত্রণ করে খুলনার মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এসব অবৈধ আয়ের বড় অংশ শেখ বাড়িতে চলে যেত। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন আগে খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ জুয়েলকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার একটা বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। গত ৫ই আগস্ট খুলনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে প্রকাশ্যে শর্টগান দিয়ে গুলি করে তিনি ব্যাপক আলোচিত হন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে খুলনা সদর থানায় মামলা হয়েছে।
কে এই দেলো: ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষের সময় কাজের সন্ধানে গোপালগঞ্জ থেকে পরিবার নিয়ে খুলনায় চলে আসেন দেলোয়ার হোসেন দেলোর পিতা আবুল হাসেম। জাতীয় পার্টির আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের দোলখোলাস্থ বাড়ির সিঁড়ির রুমে আশ্রয় পান। দেলোর বাবা দিনে রিকশা চালানো এবং রাতে কাজী বাড়ির নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করতেন। তার সাত ছেলে-মেয়ে ও নিজেরা দু’জনসহ ৯জনের সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটতো। তখন বড় ছেলে মোজাহার হোসেন মোজো বড় বাজারের ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে। বড় বোন মরিয়ম শীতলাবাড়ীর কবিরাজ মোহন ঠাকুরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।
সূত্র জানায়, পরবর্তীতে রায়পাড়ার কাস্টম বাবুদের বাড়িতে একটি ঘরভাড়া নেন আবুল হাসেম। সেখান থেকেই হয়ে যান খুলনার স্থায়ী বাসিন্দা। এক সময় বড়বাজারে সাঈদের কাপড়ের দোকানে সামান্য বেতনে কাজ শুরু করেন আবুল হাসেমের মেজো ছেলে দেলোয়ার হোসেন দেলো। পরে তিনি ভাঙ্গারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর নতুন বাজারে মাছের আড়ৎ-এ ক্লিনার হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। সুচতুর দেলো নতুন বাজারের আড়ৎদারদের কাছ থেকে বাকিতে মাছ নিয়ে খুচরা বিক্রি শুরু করেন। পাশাপাশি মাছ কোম্পানির গ্রেডার হিসেবে কাজ করতেন। বিভিন্ন কৌশলে আড়ৎদারদের কাছ থেকে মাছ ক্রয় করে মাছ কোম্পানিতে সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে আর্থিকভাবে কিছুটা সচ্ছল হন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ার সুবাদে শেখ সোহেলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
শেখ বাড়ির আশীর্বাদে যেভাবে উত্থান: শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলের আশীর্বাদে দেলো এখন মাছ কোম্পানির মালিক। সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ এলাকায় তার মাছ কোম্পানির নাম রোজেলা ফিস। ২০১০ সালে চার বন্ধুর যৌথ মালিকানায় এই মাছ কোম্পানিটি চালু করেন। পরবর্তীতে শেখ পরিবারের দাপটে তিন বন্ধুকে হটিয়ে নিজেই মালিক বনে যান। মাছ ব্যবসার অন্তরালেই চলতো তার মাদক ব্যবসা। শেখ সোহেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইয়াবার মূল হোতা হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে সখ্য হয় দেলোর। ফলে কক্সবাজার থেকে মাছের কার্টনে এ অঞ্চলে আনা হতো মাদক ‘ইয়াবা’র বড় চালান। সেই ইয়াবা খুলনা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহ করতেন তার ভাই মোজাহার হোসেন মোজো। এছাড়া দেলো-মোজোর নেতৃত্বে নগরীতে চলতো ফেনসিডিল ব্যবসা। খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে থেকে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন মোজো। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন দলীয় প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা ও শেখ সোহেলের দেহরক্ষী শওকত হোসেন সহ কতিপয় নেতা। এ অবৈধ আয়ের একটি অংশ পেতেন প্রশাসন থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতারা। দেলোর বোন মরিয়মের রয়েছে বাগমারা এলাকায় মাদক ব্যবসা।
অবৈধ আয়ের যত সম্পদ: খুলনা মহানগরীর ইসলামপুর, দোলখোলা ও রায়পাড়া এলাকা সরজমিন ঘুরে জানা যায়, দেলোয়ার হোসেন দেলোর বিত্তবৈভবের অজানা কাহিনী। রায়পাড়া রোডস্থ ইসলামপুর মসজিদের পাশেই বিলাসবহুল ৫তলা অট্টালিকা, একই এলাকার নবারণ সংসদের পাশেই একটি ৬তলা, রাজ্জাকের গলির মধ্যে একটি ৬তলা, একটি ৪তলা, দু’টি দু’তলা ও তিনটি জমি, রায়পাড়া মেইন রোডস্থ মেট্রোপলিটন ক্লিনিকের সামনে একবিঘার উপরে সিদ্দিক মঞ্জিলের জমি কেনা ১০ কোটি টাকা দিয়ে, মুসলমানপাড়া মেইন রোডের খোকা মোল্লা লেনে ৩ কাঠার একটি জমি ও আব্দুল গনি বিদ্যালয় লেনে ৫ কাঠার একটি জমি এবং শহরেও রয়েছে জমি ও দখল করা অসংখ্য প্লট। খুলনা শহরে তার বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে ১০ থেকে ১২টা। নগরীর ক্লে রোডে রয়েছে একটি মার্কেট। এছাড়া ডুমুরিয়া মৌজায় নামে-বেনামে ৪০ থেকে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানবাড়ী। সেখানে মাঝে-মধ্যে আয়োজন করা হয় পিকনিকের নামে মাদক সেবন ও জলসা। এককথায় দেলো খুলনা শহরের দৃশ্যমান একজন ভূমিদস্যু নামে পরিচিত। খুলনা ও ঢাকায় তার অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে বলেও জানা যায়। দেলোয়ার হোসেন দেলোর রয়েছে বিলাসবহুল ৭-৮টা গাড়ি। একেক সময় একেকটা গাড়ি নিয়ে তিনি মহড়া দিতেন খুলনা শহরে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন আগে খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ জুয়েলকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার একটা বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন দেলো। এ নিয়ে নগরীতে ব্যাপক আলোচনায় আসেন ওই সংসদ সদস্য।
সুন্দরবনের দস্যু ও কিশোর গ্যাং দেলোর নিয়ন্ত্রণে: সুন্দরবনের বাওয়ালী ও জেলেদের অভিযোগ-সুন্দরবনের ৫-৬টা ডাকাতদল আছে দেলো ও তার ভাই মোজোর নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া খুলনার একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা। এসব সন্ত্রাসীর কাছে রয়েছে অনেক অবৈধ অস্ত্র। অল্প সময়ে শেখবাড়ীর ছত্রছায়ায় দেলো হয়ে ওঠেন খুলনায় এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রর্দশন: সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ১৪ই আগস্ট জামায়াতের শীর্ষ নেতা প্রয়াত আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে নগরীর বসুপাড়ায় তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা চত্বরে কবর দেওয়ার অসিয়ত ছিল। কিন্তু সেখানে কবর না দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ক্যাডারদের সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এই দেলো। তিনি প্রকাশ্যে শর্টগান ও একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ১৪ই আগস্ট ২০২৩ রাতে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রতিষ্ঠিত দারুল কুরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসার মূল ফটকে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর শাখার সদস্য ও মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান সাগরের মৃত্যুর সঙ্গেও এই দেলো জড়িত আছেন বলে প্রচার আছে। এ ছাড়া গত ৮ই জুলাই খুলনা ২৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলামিনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দেলোয়ার হোসেন দেলোর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। গত ৪ঠা আগস্ট খুলনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে প্রকাশ্যে শর্টগান দিয়ে গুলি করেছিলেন দেলো। কয়েকজন ছাত্র সেদিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিএনপি অফিস ভাঙচুর, হামলা ও লুটপাটের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। ৫ই আগস্টের পর দেলো-মোজোসহ পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান।
অভিযোগ সম্পর্কে যা বলেন দেলো: অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে দোলোয়ার হোসেন দেলো বলেন, চল্লিশ বছর ব্যবসা করে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। ব্যবসার স্বার্থে শেখ পরিবারের অনেকের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল, তবে অবৈধ কিছু করিনি। আমার কোম্পানি ১০০ কোটি টাকার মাছ রপ্তানি করে। অর্থনীতিতে আমার বড় অবদান আছে। অস্ত্র প্রদর্শন ও আল্লামা সাঈদীর লাশ দাফনে বাধা দেওয়ার সময় আমি সেখানে ছিলাম না। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ও মামলা দেয়া হয়েছে।
ওর সব অবৈধ সম্পত্তি, সরকার বৈধ করে সরকারের নিজের কাছেই রাখুক আর ও জেলে বসে চাক্বিতে গম ফিসুক ।
পুলিশ প্রশাসন শেখ হাসিনার চামচা এই দেলোয়ার কে তাড়াতাড়ি ধরে আইনের আওতায় এনে তাড়াতাড়ি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেক।
খবর তো পেলেন - প্রশাসন এবার কিছু করুন.....