ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

‘বাংলাদেশের ওপর শুল্কের বোঝা ধারণার চেয়েও বড় হতে পারে’

কাউসার মুমিন, যুক্তরাষ্ট্র

(১ সপ্তাহ আগে) ৮ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ৩:০৯ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:৩৯ অপরাহ্ন

mzamin

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত ‘পারস্পরিক’ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় দেশের গার্মেন্টস শিল্প এক ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। নতুন এই শুল্ক কার্যকর হলে বর্তমানে ১৫.৬ শতাংশের সঙ্গে মিলিয়ে মোট শুল্কের হার দাঁড়াবে প্রায় ৫৩ শতাংশ, যা বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় এক বোঝা হয়ে উঠতে পারে, এবং সবমিলিয়ে বাংলাদেশের ওপর শুল্কের বোঝা ধারণার চেয়েও বড় হতে পারে। বৈশ্বিক পোশাক ও টেক্সটাইল সাপ্লাই চেইনের ব্যবসায়িক প্রকাশনা সোউর্সিং জার্নাল-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটি আশংকা করা হয়েছে। নিচে এই প্রতিবেদনটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।  

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধি ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। আমাদের মার্জিন এমনিতেই খুবই কম।’

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ২০২৪ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিদ্যমান শুল্কের পরও যুক্তরাষ্ট্রে চীন ও ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারীর তালিকায়। মার্কিন প্রশাসন এ বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়নি, তবে আমেরিকান এপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার এসোসিয়েশন (এএএফএ ) নিশ্চিত করেছে যে ৯ এপ্রিল থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হলে তা পুরাতন শুল্কের সঙ্গে যুক্ত হবে।

ইতিমধ্যেই কিছু ব্র্যান্ড প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সোউর্সিং জার্নালের এক সূত্র জানায়, গ্যাপ, লেভিস ও ওয়ালমার্ট ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগ চালান বন্ধ রেখেছে। গ্যাপ নাকি তার সাপ্লাই চেইন অংশীদারদের কাছে এই শুল্ক খরচ বহনের অনুরোধও জানিয়েছে। এদিকে ক্যালভিন ক্লেইন ও আন্ডার আর্মার-এর জন্য কার্গো পরিচালনাকারী একটি কোম্পানি সরবরাহকারীদের ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ চালান বন্ধ রাখতে বলেছে। গ্যাপ, লেভিস ও ওয়ালমার্ট এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি। সেন্ট্রিক ব্র্যান্ডস এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অন্যতম বড় পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র দ্যা নর্থ ফেস-এর মূল কোম্পানি ভিএফ কর্পোরেশন নিশ্চিত করেছে যে তারা অর্ডার বন্ধ বা বাতিল করেনি, তবে কোম্পানির আয় প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বিস্তারিত মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

এইচএন্ডএম ও ইন্ডিটেক্স (যারা) জানিয়েছে যে, তাদের কাছে আপাতত এ বিষয়ে বলার মতো কিছু নেই। পুমা বলেছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। লিড্ল জানায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে এত জটিল বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। এর বাইরে অন্যান্য বড় কোম্পানিগুলো কোনো মন্তব্য দেয়নি। বেশিরভাগ কোম্পানি এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। যদিও মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লাটনিক বলেছেন, ‘এই শুল্ক স্থগিত হবে না। এটি কার্যকর থাকবে বহুদিন ধরে।’ তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে।

নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে আছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একটি চিঠিতে তিন মাসের জন্য শুল্ক কার্যকর করা স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘মার্কিন অনেক পণ্য, যেমন কৃষিপণ্য ও স্ক্র্যাপ মেটাল, বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশ পেয়ে থাকে।’ ইউনূস জানান, বাংলাদেশ গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও মেডিকেল যন্ত্রপাতির মতো মার্কিন রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে এবং মার্কিন তুলার জন্য ডিউটি-ফ্রি বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্থাপন করতে যাচ্ছে।

বিজিএমইএ প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও রিটেইলারদের প্রতি সংহতি প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই অনিশ্চয়তা আমাদের সবাইকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। তবে একতাবদ্ধ থাকলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘এখনই দায়ভার সরবরাহকারীদের ওপর চাপিয়ে দিলে আর্থিক সংকট আরও বাড়বে।’

এদিকে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শ্রমিক নেত্রী নাজমা আখতার জানান যে, এই পরিস্থিতিতে ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে, বিশেষ করে যাদের বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে হবে।’ আখতার আরও বলেন, ‘এই সংকট রোধে ব্র্যান্ড ও রিটেইলারদেরও দায়িত্ব রয়েছে। দাম বৃদ্ধির বোঝা যেন শ্রমিকদের ওপর না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল ক্রেতারাই পারে এই বোঝা নিজেদের কাঁধে নিয়ে শ্রমিকদের প্রাপ্য নিশ্চয়তা দিতে।’

অ্যাবারডিন ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুল এবং ন্যায্য বাণিজ্য সংস্থা ট্রান্সফর্ম ট্রেডের যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে ১,০০০ পোশাক প্রস্তুতকারকের মধ্যে ৭৬ শতাংশ জানিয়েছেন যে, মার্চ ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ সময়কালে অর্ডারের দাম বাড়েনি, যদিও জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আরও উদ্বেগজনকভাবে, ৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন যে, তারা পোশাক তৈরি করছেন এমন দামে যা উৎপাদন খরচের চেয়েও কম —এমনকি লাভজনক ব্র্যান্ড যেমন সিএন্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম এবং ইন্ডিটেক্স-এর মতো লাভজনক ব্রান্ডের বেলাতেও এমনটি করতে হচ্ছে।  

এমতাবস্থায়, নতুন শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর পোশাক খাত আরও সংকটের মুখে পড়বে, যা ধারণার চাইতেও বেশী হতে পারে। এখন সময়ই বলে দেবে, শেষ পর্যন্ত কূটনৈতিক তৎপরতা কতটা কার্যকর হয়।

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status