বাংলারজমিন
যেভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েন উচ্চমান সহকারী দেলোয়ার
প্রতীক ওমর, গাইবান্ধা থেকে ফিরে
৯ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার
নাম দেলোয়ার হোসেন। নৈশপ্রহরী পদে মাস্টার রোল কর্মচারী হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদে। বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা পরিষদে উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত। প্রায় দুই দশকে গাইবান্ধা জেলা পরিষদে বেশ পাকাপোক্ত করেছেন নিজের অবস্থান। বিভিন্ন সময় চেয়ারম্যান, প্রশাসক ও কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নিজস্ব বলয় তৈরি করে মেতে ওঠেন লুটপাটে। শূন্য থেকে এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন দেলোয়ার। চাকরিরত অবস্থায় মাদক মামলায় কারাগারে ছিলেন বেশ কিছুদিন। কারাভোগের পর জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। শুধু তাই নয়, জাল রসিদ ছাপিয়ে জেলা পরিষদের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় হাতেনাতে ধরাও পড়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সই নকল করে একজনের জমির লিজ আরেকজনকে দিয়ে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ। চাকরি দেয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়া, জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের পাহাড়সম অভিযোগ নিয়েও বহাল তবিয়তে তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারী। সবশেষ সহকর্মীর স্ত্রীকে ব্লাকমেইল করে দিনের পর দিন ধর্ষণের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এতকিছুর পরও কোনো শাস্তি তো দূরের কথা উল্টো পদোন্নতি পেয়ে দেলোয়ার এখন গাইবান্ধা জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী। অনেক অভিযোগ তদন্তে প্রমাণের পরও দেলোয়ার প্রশ্নে নীরব কর্তৃপক্ষ। বারবার অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন দেলোয়ার। দেলোয়ারের কল্যাণে একই প্রতিষ্ঠানে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পান তারই দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীন। প্রথম স্ত্রীর বড় মেয়ে ফারহানা আক্তারকে নিয়োগ দেন লাইব্রেরিয়ান পদে। সামান্য বেতনের চাকরি করে দেলোয়ার এখন বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক নন শুধু- জায়গা-জমিসহ হয়েছেন প্রায় কোটি কোটি টাকার মালিক।
হাতে নাতে ধরা পড়ে জালিয়াতি: ২০১৪ সাল। মাদক মামলায় গ্রেপ্তারের কারণে সাময়িক বহিষ্কার আদেশ ছিল দেলোয়ার হোসেনের কাঁধে। তারপরও থেমে থাকেনি অদম্য দেলোয়ারের অপরাধ। জেলা পরিষদের জমি লিজ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ভাড়া তুলতে থাকেন তিনি। কিন্তু তা বৈধ উপায়ে নয়। জেলা পরিষদের টাকা আদায়ের রসিদ বই ছাপিয়ে কর্তৃপক্ষের সই ও সিল জাল করে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন। বিষয়টি অবগত হয়ে দেলোয়ারের সরকারি বাসভবন থেকে নকল রসিদ বহি জব্দ করেন জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কল্লোল কুমার চক্রবর্ত্তী। পরে এ ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন তৎকালীন সচিব ড. মো. সাইফুল আলম। তদন্তকালে নকল রসিদ বহি ছাপিয়ে অর্থ আদায়, রাজস্ব খাতে ভাড়ার টাকা জমা না দিয়ে আত্মসাতের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুল আলমের কাছে লিখিতভাবে স্বীকার করেন দেলোয়ার। শুধু তাই নয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সিলমোহর ও স্বাক্ষর জাল করে জাল চুক্তিপত্র তৈরি করে একজনের লিজ বাতিল করে আরেকজনকে লিজ দিয়ে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টিও তদন্তে প্রমাণিত হয়। এ দফায় লিখিতভাবে মাফ চেয়ে পার পেয়ে যান অভিযুক্ত দেলোয়ার।
পরিষদের সদস্যদের অভিযোগ: পরিষদের ১৯ সদস্যের মধ্যে ১২ জন সদস্য দেলোয়ারের অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে গাইবান্ধার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালককে ২০২১ সালের ২৬শে আগস্ট তদন্তের নির্দেশ দেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন উপ-সচিব মোহাম্মদ তানভীর আজম ছিদ্দিকী। লিখিত অভিযোগে, দেলোয়ারের বিরুদ্ধে মাদকাসক্তি, জেলা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ নথি ও ফাইলপত্র নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে গায়েব করা, পুড়ে ফেলার অভিযোগ নিয়ে আসেন জেলা পরিষদের তৎকালীন সদস্যরা। প্রভাবশালী ও মাসকসেবীদের মাধ্যমে জেলা পরিষদের কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার অভিযোগও আছে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে। সভাপতি হওয়ার পর, কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণ, ফাইল থেকে কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ সরিয়ে বেকায়দায় ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত আর সেই তদন্তের দৃশ্যমান কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি।
স্বামী-স্ত্রীর যত সম্পদ: ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পস্তমপুর গ্রামে দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীন ২০২২ সালে স্থানীয় হারুন অর রসিদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকায় ৬০ শতক জমি ক্রয় করেছেন। বছর কয়েক আগে গাইবান্ধা সদর উপজেলার ধানঘড়া গ্রামে ১৬ শতক জমি ক্রয় করেন তারা। যেখানে নির্মাণ করেছেন একটি বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির পাশাপাশি তারা গাড়িরও মালিক হয়েছেন। ক্রয় করেছেন মাইক্রোবাস। যার নম্বর- ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৬৯০। দেলোয়ারের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীন জেলা পরিষদের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হলেও তিনি এখন এনজিওর নির্বাহী পরিচালক। নিজের বিলাসবহুল বাড়ির নিচতলায় খুলেছেন নিরাশা দূরীকরণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএসডিও নামের এনজিও।
ঘাট ইজারার নামে অর্থ আত্মসাৎ: গাইবান্ধা জেলা পরিষদের অধীনে হরিপুর খেয়াঘাট ইজারা দেয়ার নামে ২০২৩ সালে সুন্দরগঞ্জের এস এম ফারুকুল ইসলাম ফারুকের কাছ থেকে নগদ ১১ লাখ ৮০ হাজার নেন দেলোয়ার হোসেন। পরবর্তীতে ঘাট ইজারা দিতে না পেরে দেলোয়ার চেকের মাধ্যমে ফারুককে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই চেক ডিজঅনার করেন। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে ফারুক ২০২৪ সালের ১৪ই জানুয়ারি সুন্দরগঞ্জ আমলি আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বাদী ফারুক বলেন, এই টাকার জন্য দুই বছর ধরে তিনি ভোগান্তি ভোগ করছেন। তিনি বলেন, মামলাটি আদালতে এখন চার্জ গঠনের অপেক্ষায়। আসামি দেলোয়ার বারবার সময়ের প্রার্থনা করে বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করছেন।
চাকরি দেয়ার নামে অর্থ আত্মসাৎ: অভিযোগ আছে জেলা পরিষদে মাস্টার রোলে লাইব্রেরিয়ান, নকশাকারক, কার্যসহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দারোয়ান কাম কেয়ারটেকারসহ বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয় দেলোয়ার। জেলা পরিষদের অভিযুক্ত উচ্চমান সহকারী দেলোয়ার হোসেন বলেন, জীবনে চলার পথে মানুষের কিছু ভুল-ত্রুটি থাকে। আর যে কাজ বেশি করে তার ভুল বেশি হয়। আমারও কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে। আমি হাউজ বিল্ডিং বাবদ ৩৪ লাখ টাকা অফিসিয়াল ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছি। তবে দুর্নীতির বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি প্রকারান্তরে তা স্বীকারও করেছেন। জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম হেদায়েতুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমি সবেমাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। দেলোয়ারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানতে পারিনি। আপনার মাধ্যমে সব জানলাম, এখন তার বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
পাঠকের মতামত
Ar God father ace. Please check whoich god father. From Bogura