শেষের পাতা
সিলেট বিআরটিএ
৫০ কোটি টাকা ঘুষ-বাণিজ্যের যে আয়োজন
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
ঘুষ-বাণিজ্যের শীর্ষে যেসব খাত রয়েছে তার মধ্যে বিআরটিএ অন্যতম। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না এখানে। ঘুষের সাম্রাজ্য সিলেট বিআরটিএ-তে নতুন করে ৫০ কোটি টাকা ঘুষের মহা আয়োজন চলছে। এই আয়োজনের অনুষঙ্গ হচ্ছে সিএনজি-অটোরিকশা। প্রায় ১০ বছর ধরে সিএনজি-অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দেয়া বন্ধ। নতুন করে তিন হাজার সিএনজি-অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দিতে চলছে ‘গোপন মিশন’। সিলেট বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, নতুন সিএনজি-অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন দেয়া বন্ধ রয়েছে। যদি রেজিস্ট্রেশন দিতে হয় তাহলে আরটিসি’র সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেটি করতে হবে। এখন পর্যন্ত আরটিসি’র সভায় এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী মাসের শেষের দিকে সিলেটে আরটিসি’র সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। যদি এ সভায় নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় তাহলে প্রক্রিয়া শুরু হবে। সিএনজি মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, নতুন তিন হাজার সিএনজি-অটোরিকশা দেওয়ার একটি বার্তা সিলেট বিআরটিএ’র শীর্ষ মহল থেকে গোপনে ঘোষণা করা হয়েছে। আর এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিআরটিএ’র দালাল ও সুবিধাভোগীরা গোপনে ফাইল নেয়া শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়া অনেকটা প্রকাশ্যে চলছে। এ নিয়ে হুলস্থুলও কাণ্ডও ঘটছে সিলেটে। অটোরিকশা পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, সিলেটে প্রায় ১৯ হাজার ২০০টি বৈধ সিএনজি-অটোরিকশা রয়েছে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত সিলেট বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে এদের বৈধতা দেয়া হয়েছিল। গত ১০ বছরে নগরের একাধিক শোরুম থেকে আরও প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার সিএনজি-অটোরিকশা বিক্রয় করা হয়েছে। সেই সিএনজি-অটোরিকশাগুলো অনটেস্ট হিসেবেই সিলেট নগরে চলাচল করছে। পুলিশের টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে সিলেটে চোরাই ও অন্য জেলার সিএনজি-অটোরিকশার সংখ্যা হবে আরও ১০-১২ হাজার। এ সিএনজি-অটোরিকশাগুলোও সিলেটের সড়কে চলছে। অবৈধ সিএনজি-অটোরিকশাগুলো এখন গলার কাঁটা। যানজটের অন্যতম কারণ। ধারণ ক্ষমতার বাইরে গাড়ি চলছে সিলেটের সড়কে। এজন্য সিলেট জেলা অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বারবারই প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয়েছে অবৈধ অটোরিকশা সড়ক থেকে সরানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সরানোর উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। এই অবস্থায় বিআরটিএ’র কর্মকর্তা গত পাঁচ বছর ধরে ‘দুর্নীতির মহোৎসব’ চালাতে নতুন সিএনজি-অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দিতে দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ার কারণে আরটিসি’র সভাপতি হিসেবে সিলেটের জেলা প্রশাসক নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়ার অনুমতি দেননি। রমজানের পূর্বের বিআরটিএ’র শীর্ষ কর্মকর্তারা সিলেটে এসে মতবিনিময় করে গেছেন। সেখানেও নতুন সিএনজি-অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশনের প্রসঙ্গটি উঠলে সিএনজি-অটোরিকশার মালিক ও শ্রমিকরা এতে আপত্তি তোলেন। পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ঈদের পর নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়ার বিষয়টি সিলেট বিআরটিএ’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের তরফ থেকে প্রচার করা হয়। আর এই প্রচারে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফাইল গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার ফাইল গ্রহণ করা হয়েছে।
বিআরটি’র অনেক কর্মকর্তারা গোপনে ফাইল নিচ্ছেন। একটি সিএনজি-অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন বাবদ সরকারি ফি সবমিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার প্রয়োজন। সেখানে রেজিস্ট্রেশন বাবদ টাকা বাদে অতিরিক্ত আরও ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার দেয়ার প্রস্তাব সিএনজি মালিকদের দেয়া হয়েছে। সব টাকা এখনই নেয়া হচ্ছে না। কারও কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা, কারও কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে রাখা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, বিআরটিএ’র কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ইতিমধ্যে হাজারো ফাইল গোপনে সংগ্রহ করে রেখেছেন। রেজিস্ট্রেশনের অনুমতি মিললেই দ্রুত সেগুলো করে দেবেন। এ ছাড়া সিলেটের আদালতপাড়ার কিছু সংখ্যক দালাল, কয়েকজন মুহুরী ফাইল নিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে- আবুল, আলাল. রানু বাবু সহ কয়েকজন। তারাও ইতিমধ্যে ৪ থেকে ৫শ’ ফাইল গ্রহণ করেছেন। অগ্রিম হিসেবে তারা টাকাও নিচ্ছেন। এ ছাড়া সিএনজি-অটোরিকশা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান মা-মনি, শাহ এন্টারপ্রাইজ ও মহানগর অটোস’র পক্ষ থেকে ফাইল গ্রহণ করা হচ্ছে।
ঈদ পরবর্তী সময় থেকে নির্ধারিত ব্যাংকে নতুন রেজিস্ট্রেশনের চালানের টাকা জমা দেয়া হচ্ছে। মালিক ও চালকরা জানিয়েছেন, সাবেক সরকারের সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর ইশারায় ২০১৯ সালে একইভাবে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে নতুন রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফাইল জমা নেয়া হয়েছিল। ওই সময় কয়েক হাজার ফাইল ও টাকা জমা নেন তখনকার বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি ও তুমুল বিতর্ক দেখা দেয়ার কারণে আরটিসি’র সভায় সেটির আর বৈধতা দেয়া সম্ভব হয়নি। টাকা জমা দিয়ে অনেক অটোরিকশার মালিক তখন প্রতারিত হয়েছিলেন। মালিক ও চালকরা অভিযোগ করেছেন, বর্তমান সহকারী পরিচালক মো. আবু আশরাফ সিদ্দিকী আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সিলেট থেকে চলে যাবেন। যাওয়ার আগে তিনি নতুন সিএনজি-অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের নামে ঘুষ-দুর্নীতির এ আয়োজন শেষ করতে চাইছেন। এজন্য তার নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে নতুন করে ফাইল গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বিআরটিএ’র কর্মচারী রাজু, ঋতু ও ইমনের নাম প্রকাশ্যে এসেছে। তারা পরিদর্শকদের হয়ে ফাইল গ্রহণের কাজে নেমেছেন। এ ব্যাপারে সিলেট বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মো. আবু আশরাফ সিদ্দিকী জানিয়েছেন, নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে ভুয়া প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যদি সিদ্ধান্ত হয় তাহলে কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।