প্রথম পাতা
রেমিট্যান্স
যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে কমেছে মধ্যপ্রাচ্যে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবারবর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য মতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ২ হাজার ১৭৮ কোটি ৪৪ লাখ (২১.৭৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮.৫৮ শতাংশ বেশি। আর রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। দেশটি থেকে জুলাই-মার্চ সময়ে ৩৯৪ কোটি ৬১ লাখ (৩.৯৪ বিলিয়ন) ডলার এসেছে, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৮.১১ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৪ কোটি ৩১ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স আসা অব্যাহতভাবে কমছে। আগে রেমিট্যান্স মানেই সৌদি আরব। কিন্তু গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘটে ব্যতিক্রম; ওই অর্থবছরে সৌদিকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেটাও উল্টে গেছে। এখন সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এতদিন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও নেই।
গত বছরের ৫ই আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন। ক্ষমতার এই পালাবদলে আগস্ট থেকে প্রবাসী আয়ও বাড়তে শুরু করে।
ব্যাংকাররা বলছেন, রেমিট্যান্সে যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে তা মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই হয়েছে। প্রতি মাসেই বেশি প্রবাসী আয় আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমেছে, বন্ধ হয়েছে অর্থ পাচার। এ ছাড়া খোলাবাজার এবং ব্যাংকে রেমিট্যান্সের ডলারের একই দাম পাচ্ছেন প্রবাসীরা। এসব কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ৩.১২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। সৌদি আরবের প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২.৭৭ বিলিয়ন ডলার। অন্য দেশগুলোর মধ্যে এই ৯ মাসে যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ২.১৬ বিলিয়ন ডলার। মালয়েশিয়ার প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১.৮৯ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১.৯৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরব থেকে এসেছিল ১.৯৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২.১৪ বিলিয়ন ডলার। মালয়েশিয়ার প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১.২১ বিলিয়ন ডলার। হিসাব বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১০২.৭৫ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল যে দেশ থেকে, সেই আরব আমিরাত থেকে এই ৯ মাসে কমেছে ৫.৪২ শতাংশ। সৌদি আরব থেকে অবশ্য ৪০.৮৫ শতাংশ বেড়েছে। মালয়েশিয়া থেকে আরও বেশি বেড়েছে, ৫৫.৬৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্য থেকে বেড়েছে ১ শতাংশ।
এদিকে রেমিট্যান্সের এ গতিধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাস এপ্রিলের প্রথম ১৯ দিনেই এসেছে ১৭১ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ২০ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। চলতি মাসে প্রতিদিন গড়ে আসছে ৯ কোটি ডলার বা ১১০৪ কোটি টাকার বেশি।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
প্রবাসী আয়সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের নবম মাস মার্চে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা মোট ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ (৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে যা রেকর্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো মাসে এত বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার এসেছে আরব আমিরাত থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ৩৮ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার ডলার। মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ২৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা ২৫৩ কোটি (২.৫৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ৪৯ কোটি ১৩ লাখ ডলার। ৩৩ কোটি ৪৯ লাখ ডলার এসেছিল আরব আমিরাত থেকে। সৌদি আরব থেকে আসে ৩২ কোটি ডলার। আর যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ৩২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। এই বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার আসে যুক্তরাজ্য থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছিল ২৭ কোটি ডলার। আরব আমিরাত থেকে আসে ২৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৯৪ কোটি ৬১ লাখ (৩.৯৪ বিলিয়ন) ডলার এসেছে, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৮.১১ শতাংশ।
কয়েকটি ব্যাংকের নির্বাহীরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়া মানে দেশটি থেকে প্রকৃত প্রবাসী আয় বেড়েছে হয়তো তেমন নয়। অন্যান্য দেশের আয়ও প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে। এ কারণে পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বড় প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে কাগজে-কলমে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, প্রথমত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছিল। সে কারণে সেখানকার প্রবাসীরা দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে কম টাকা পাঠিয়েছিলেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কমে স্বাভাবিক হয়েছে। অর্থনীতিও চাঙ্গা হচ্ছে। তাই এখন আমাদের প্রবাসীরা বেশি টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার প্রায় ২০ শতাংশ গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বর্তমানে দেশটিতে ১৫ লাখের মতো প্রবাসী কাজ করছেন। বিএমইটি’র হিসাবে, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা ৫০ লাখের বেশি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে; কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়। আর যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখের মতো প্রবাসী অবস্থান করছেন।