ঢাকা, ২৬ মে ২০২৫, সোমবার, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

বিভিন্ন দলের নেতাদের বৈঠক

নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা

স্টাফ রিপোর্টার
২৬ মে ২০২৫, সোমবার
mzamin

যত বাধা, বিপত্তিই আসুক না কেন জনগণের দেয়া দায়িত্ব পালন করে যেতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুরোধ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। একই সঙ্গে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছেন তারা। দলগুলো মনে করে, সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি সেটি সরকারকে সম্পন্ন করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দরকার। তাহলে অনাস্থা, অবিশ্বাসের যে দেয়াল তৈরি হয়েছে সেটি কেটে যাবে। এ ছাড়াও দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে একটি দল। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বলেছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তারা চায় বাংলাদেশ যেন আবার গোলামিতে ফেরত যায়। নির্বাচনের বিষয়ে সরকারপ্রধান জানান, ৩০শে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এর একদিন পরও হবে না। 

গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এমনটাই জানান দলগুলোর নেতারা। বিকাল থেকে দুই দফায় ১৮টি দল ও সংগঠনের শীর্ষ নেতারা সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রথম দফার বৈঠকে অংশগ্রহণকারী নেতাদের মধ্যে ছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়কারী টিপু বিশ্বাস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু, বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি’র সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন। দ্বিতীয় দফায় হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের (একাংশের) আমীর মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের অন্য অংশের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জাতীয় নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার এবং ইসলামী ঐক্য জোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি বৈঠকে অংশ নেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। 

বৈঠক শেষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সংস্কারে বেশি সময়ক্ষেপণ করলে, এটা সরকারের জন্য উল্টো হতে পারে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। আমরা বলেছি, পরিস্থিতির দিকে ভালো করে নজর রাখতে হবে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে নানা রকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অভ্যুত্থানের বিজয়কে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র আরও পেকে উঠছে। সেখান থেকে যদি দেশকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। তিনি আরও বলেন, জনগণের অংশগ্রহণের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনে যে সংস্কার দরকার, সেগুলো করে দিয়ে আমরা যদি জনগণের অংশগ্রহণের সংস্কার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাই তাহলে এটাই হবে সার্থক। 

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংকট কাটাতে আমরা তাকে বুঝিয়েছি আপনার বেশি করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করতে হবে, কথা বলতে হবে, মতবিনিময় করতে হবে। আপনি কেমন করে নির্বাচন করতে চান তা সকলের সঙ্গে শেয়ার করবেন। উনি বলেছেন যে, আমি কোনোভাবেই চাই না আমার ক্ষমতা আরও দীর্ঘায়িত করতে। উনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় আর বাড়াতে চান না। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, গত কয়েকদিনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা বিব্রত হয়েছিলেন। তাই পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন। আমরা বলেছি- এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি সবাইকে যেন সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। কারণ সরকারের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। উপদেষ্টারা একেক সময় একেক কথা বলছেন। করিডোর ও বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে বলা হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ করার দাবি জানিয়েছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের মানুষ ১৬ বছর ধরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা আপনাদের যৌক্তিকভাবে সহযোগিতা করতে চাই এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। 

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা বলেছি আগামী ৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে যথাসম্ভব নির্বাচন আয়োজন করার জন্য। তবে সেটা চাপিয়ে দিয়ে নয়, তিনি তার সুবিধামতো সময়ে নির্বাচন করবেন। স্থিতিশীল একটা অবস্থানে গেলে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। তবে উনি বলেছেন আমি কিন্তু নানা কারণে অত্যন্ত হতাশ। বৈঠকে সিনিয়র রাজনীতিবিদরা ছিলেন, তারা বলেছেন যে আপনি হতাশ হবেন না। আপনাদের যে সমস্যা-ত্রুটিগুলো আছে সেগুলো দূর করে এগিয়ে যান। 

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দায়িত্ব নিয়েছেন, আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, এটি সম্পন্ন করেই তাদের যেতে হবে। অন্য কিছুর সুুযোগ নেই। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যেহেতু জনগণ একটা ভরসার জায়গায় রেখেছে তাকেই এসব দায়িত্ব সম্পন্ন করে যেতে হবে। যত বাধা, বিপত্তি, প্রতিকূলতাই থাকুক না কেন, যেগুলো তার মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, তবুও তাকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নানা ধরনের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে যা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে অনাস্থা দূর করতে হবে। নির্বাচনের বিষয়ে সরকার বলেছেন যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। তবে আমরা বলেছি, এ বিষয়ে যদি একটি সুনির্দিষ্ট সময় বলা যায় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো একটি প্রস্তুতি নিতে পারবে। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি  সৈয়দ রেজাউল করিম বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা বলেছি দেশের মানুষের প্রয়োজনে আমরা আপনাকে নিয়ে এসেছি। মাঝসমুদ্রে আপনি আমাদের ফেলে চলে যাবেন এটা হতে পারে না। সুষ্ঠু নির্বাচনে পেশিশক্তি, কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ না হলে তো পূর্বের মতো নির্বাচন হবে। গণহত্যাকারীদের, আয়নাঘর যারা বানিয়েছে তাদের বিচার দৃশ্যমান করতে হবে। স্থানীয় নির্বাচন আগে দেয়ার জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। দেশ গড়ার ব্যাপারে আমরা যেন সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারি। আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। উনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন জুনের একদিনও পরে নির্বাচন হবে না। করিডোর প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন দেশের কোনো ক্ষতি হবে না। 

হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান বলেন, বিগত আমলে হেফাজতের বিরুদ্ধে ৩০০ মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছিল। আমরা জুনের মধ্যে সকল মামলা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানিয়েছি। নারী সংস্কার কমিশন বাতিল করতে আমরা বলেছি। খেলাফত মজলিশের আমীর মাওলানা মামুনুল হক বলেন, খোলামেলা পরিবেশে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা চলছে এর মধ্যে তিনি যেন হাল ছেড়ে না দেয় সে বিষয়ে আমরা অনুরোধ করেছি। তিনি নির্বাচনের সময়সীমা স্পষ্টভাবে বলেছেন জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি আমরা দেখতে পাইনি। এনিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। ফ্যাসিবাদী আমলের সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করার কথা বলেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন অতি দ্রুত আমরা ভালো সংবাদ পাবো। অন্তত দু’চারটা বিচার কাজ দৃশ্যমান হবে। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, আমাদের আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে যারা উপদেষ্টা রয়েছেন। তারা যেহেতু একটি দল করেছেন, বাইরে এ কথাটি প্রচলিত আছে যে, এই দলটি সরকারের সুবিধা পাচ্ছে এবং সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনসিপি’র দুইজনকে অপসারণ করা বা তাদেরকে বুঝিয়ে পদত্যাগের দিকে যাওয়া সরকারের দিক থেকে একটি ভালো দিক হবে। 

বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বৈঠকে দলগুলোর নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছেন। সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচনের জন্য যে কাজগুলো সরকার করছে, সেগুলোতে তারা সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন, এসব বিষয়ে তারা সরকারের পাশে থাকবেন। নির্বাচনের বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ৩০শে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এর বাইরে যাবে না। শফিকুল আলম বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্যার বলেছেন- আমরা বড় যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর দেশকে অস্থিতিশীল করার সব রকম চেষ্টা চলছে। দেশে- বিদেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এটা থেকে দেশকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন- বিভাজন থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে। ঐকমত্য থাকতে হবে। আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে আমরা যতটুকু এগিয়েছি সেটি যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বলেছেন- আপনারা বসায় আমি সাহস পেয়েছি। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে আমি অপরাধী অনুভব করবো। অভ্যুত্থানের পর আমরা মহা সুযোগ পেয়েছি দেশকে এগিয়ে নিতে। সে লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। কিন্তু যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা চায় আমরা যেন এগোতে না পারি। দেশ যেন আবার গোলামিতে ফেরত যায়। তিনি এও বলেছেন- আমি যতদিন আছি দেশের অনিষ্ট হবে- এমন কোনো কাজ হবে না নিশ্চিত থাকুন। 
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status