শেষের পাতা
জুলাই অভ্যুত্থান
গুলিবিদ্ধ সুজন গুনছেন মৃত্যুর প্রহর
হাসান পিন্টু, লালমোহন (ভোলা) থেকে
৪ জুন ২০২৫, বুধবার
২০২৪ সালের ১৮ই জুলাই। তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজধানী ঢাকা। ওই আন্দোলন দমাতে মতিঝিল এলাকায় নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলি চালাতে থাকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মমতা দেখে প্রতিবাদী হয়ে এগিয়ে যান ৩৭ বছর বয়সী যুবক মো. জহিরুল ইসলাম সুজন। মতিঝিলের নটর ডেম কলেজ সংলগ্ন এলাকায় তার ফাস্টফুডের দোকান ছিল। যার সুবাধে আন্দোলনকারী বহু শিক্ষার্থী এবং হামলাকারীদের অনেকেই ছিল তার চেনা। শিক্ষার্থীদের ওপর চলা নির্মমতা মানতে পারেননি সুজন। ১৮ই জুলাই দুপুরের দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। তবে বিকেলের দিকে তার মেরুদণ্ডের ভেতর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের করা পিস্তলের গুলি ঢুকে। এরপর তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে নেন শিক্ষার্থীরা। যুবক জহিরুল ইসলাম সুজন ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের করিমগঞ্জ এলাকার মো. কামাল উদ্দিনের ছেলে।
আন্দোলনে আহত সুজন জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেলে ১৫ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর আমাকে সাভার সিআরপি হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখান থেকে প্রায় ৬ মাস চিকিৎসা নিয়েছি। তখন চিকিৎসকরা জানান, আমার মেরুদণ্ডের ভেতর একটি গুলি ঢুকেছে। এটি বের করা যাবে না। বের করতে হলে মৃত্যুর শঙ্কা বেশি। যার জন্য চিকিৎসকরা আর গুলিটি বের করেননি। এরপরও কিছুটা স্বস্তি অনুভব করায় চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে বাড়িতে আসি। তবে দুই মাসের মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়, অসহনীয় যন্ত্রণা হওয়ায় ফের ঢাকায় গিয়ে সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি হই। তার কয়েকদিনের মাথায় বাড়িতে আমার বৃদ্ধ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। যার জন্য গত ১৮ই মে আবার বাড়ি আসি। এর একদিনের মাথায় বাবা মারা যান। তারপর আর ঢাকায় যাওয়া হয়নি। আন্দোলনে আহতদের মধ্যে সরকারি তালিকায় ৩৩৭ নম্বরে আমার নাম রয়েছে।
তিনি জানান, মেরুদণ্ডের ভেতর এখনো গুলি থাকায় কোমড়ের নিচের পুরো অংশ অবশ হয়ে গেছে। এজন্য কোমড়ে প্রচণ্ড ব্যথা। অবশ হওয়া অংশ দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। নিজে চলাফেরাও করতে পারি না। সারাদিন বাসায় শুয়ে থাকতে হয়। ওষুধ খেলে ব্যথা কিছুটা কমে, না খেলেই অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। এখন প্রতিদিন আমাকে নিয়মিত চারশত থেকে পাঁচশত টাকার ওষুধ খেতে হয়। এ নিয়ে এখন চরম অর্থ সংকটে ভুগছি। কারণ আমার স্ত্রীসহ তিন সন্তান রয়েছে। এরা সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সরকারিভাবে চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য দুই লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। তবে যেহেতু আমিই সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তাই ওই টাকা দিয়ে সংসারে কিছু খরচ করার পাশাপাশি চিকিৎসাও চালিয়েছি। আবার বাবা জীবিত থাকাকালীন সময় তিনিও বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। এখন তিনিও নেই, টাকাও নেই। তাই চিকিৎসা চালাতে পারছি না, আর সংসার চালাতেও হিমশিম খাচ্ছি।
সুজন আরো জানান, নিজের অসুস্থতার চেয়ে এখন মহাচিন্তা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। কারণ আমরা মধ্যবিত্ত। সম্পদ বলতেও তেমন কিছু নেই। আমি না থাকলে তাদের ভবিষ্যতে কি হবে? সন্তানদের মধ্যে তিনজনই ছেলে। তাদের মধ্যে বড় ছেলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ে, মেঝো ছেলে পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। আর ছোট ছেলের বয়স মাত্র ৬ মাস। আমার কিছু হলে এরা কোথায় যাবে, কি করবে তাই ভেবে উঠতে পারছি না। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করবো উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে আমার মেরুদণ্ডের গুলিটি বের করে যেন আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়। এ ছাড়া আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেও যেন সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। না হয় মরেও শান্তি পাবো না। কারণ আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে স্বৈরাচার মুক্ত হলেও জীবিত থাকতে একদিনের জন্যও নিজে মুক্তভাবে চলতে পারিনি!
এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আজিজ বলেন, ২৪-এর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা শহিদ এবং আহত হয়েছেন তাদের জন্য সরকারি যেসব বরাদ্দ এসেছিল তা আমরা পৌঁছে দিয়েছি। এ ছাড়া পরবর্তীতে এসব ব্যক্তিদের জন্য কোনো বরাদ্দ আসলে তা-ও সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া হবে।
পাঠকের মতামত
এদের কে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাতার ব্যাবস্তা করার জন্য জোড় দাবি জানাসি