বিশ্বজমিন
মন্তব্য প্রতিবেদন
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ ও মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের ক্রমাবনতি: এক নির্মম বাস্তবতা
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
(২ সপ্তাহ আগে) ১৬ জুন ২০২৫, সোমবার, ১০:২০ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:২৯ অপরাহ্ন

ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের যে ভয়াবহ পরিণতি দেখা যাচ্ছে, তা শুধু দুই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের ভঙ্গুর অবস্থান, কূটনৈতিক দুর্বলতা এবং নীতিহীনতার নগ্ন প্রকাশ। যখন গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন মাসের পর মাস ধরে চলছে, যখন সিরিয়ায় নাগরিকদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়েছে এবং যখন আজ ইরানের বিভিন্ন শহরে বোমা পড়ে মানুষ নিহত হচ্ছে- তখন মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশ সরকার কেবল মৌনদর্শক কিংবা দ্বিমুখী বিবৃতির আশ্রয় নিয়েছে। এই নিষ্ক্রিয়তা শুধু দুঃখজনক নয়, এটি ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ।

ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে চালানো ইসরাইলি বিমান হামলা এবং তেহরানের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ- এই ঘটনাপ্রবাহ মধ্যপ্রাচ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থার সূচনা করেছে। যদি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তবে তার পরিণতি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়- পুরো বিশ্বকে ভোগ করতে হবে। ইরান এখনও হরমুজ প্রণালীতে কোনো আঘাত করেনি। তেল সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটায়নি। রোববারের হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনালে মোহাম্মদ কাজেমি, তার ডেপুটি হাসান মোহাকিক সহ মোট তিনজন জেনারেলকে হত্যা করেছে ইসরাইল।

এর আগে তারা আইআরজিসির প্রধান হোসেইন সালামি, সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ডেপুটি ফর অপারেশন্স মেহদি রাবানি, ডেপুটি ফর ইন্টেলিজেন্স গোলাম রেজা মেহরাবি, দীর্ঘ সময় এরোস্পেস প্রধান আলি আকবার হাজিজাদেহ, বহু সংখ্যক পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। ধ্বংস করে দিচ্ছে পারমাণবিক স্থাপনা, বিমানবন্দর, তেলের ডিপো সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ইসরাইল দাবি করছে, তারা তেহরানের আকাশসীমার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং যেকোনো সময় ‘তেহরানকে জ্বালিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিচ্ছে।
অপরদিকে ইরান প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তির ঘাঁটিগুলোতেও হামলার হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি ইরানি নেতাদের জন্য এখন পর্যন্ত ‘বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেঁড়ো’। কারণ, তারা ইসরাইলে হামলা করলেও তাদের যে পরিমাণ ক্ষতি ইসরাইল করেছে তার তুলনামুলক কোনো স্থাপনায় হামলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে শুধু ক্ষোভই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু ইসরাইল ও ইরানের ব্যাপার নয়- এটি গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক পরীক্ষা। কিন্তু এই পরীক্ষায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ব্যর্থ হচ্ছে।

যখন গাজার এক শিশু ধ্বংসস্তূপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়, তখন কিছু মুসলিম রাষ্ট্রের মুখ থেকে যৎসামান্য ‘দুঃখ প্রকাশ’ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। আর যখন তেহরান, ইসফাহান বা কেরমানশাহে বিপুল পরিমাণ সাধারণ মানুষ নিহত হন, তখনও একই নীরবতা। অথচ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সংহতি, কূটনৈতিক চাপ এবং সম্মিলিত অবস্থানই যুদ্ধ প্রতিহত করার প্রধান উপায়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, তুরস্ক- মুসলিম বিশ্বের এই প্রধান শক্তিগুলো নিজেরা বিভক্ত, স্বার্থপর এবং পশ্চিমা ব্লকের কৌশলগত অংশীদার। কেউ কেউ হয়তো মৌখিকভাবে ইসরাইলের হামলার নিন্দা করেছে, কিন্তু তা রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ বা কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থানে রূপ নেয়নি।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ইসরাইলি হামলার নিন্দা করেছেন- এ যেন নৈতিক দায় মেটানোর এক ধরনের ‘দায়িত্ব পালন’। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন আগেই ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সুতরাং, তাদের পক্ষে ইরানের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া কল্পনাতীত।
এই পরিস্থিতি নতুন নয়। মুসলিম বিশ্বের এই অনৈক্য, বিভাজন এবং আত্মঘাতী কূটনীতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে। ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকো চুক্তি, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন বিভাজন, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলা- প্রতিটি পর্বেই মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত থেকে বড় শত্রুকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনের ইস্যুতে আজও একটি অভিন্ন মুসলিম অবস্থান তৈরি হয়নি। কেউ হামাসকে সন্ত্রাসী বলে, কেউ গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠায়; কিন্তু কেউই একটি সম্মিলিত রাজনীতিক চাপে ইসরাইলকে প্রতিহত করতে পারেনি।
ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও বহু মুসলিম দেশের কাছে রাজনৈতিকভাবে একঘরে। সুন্নি-শিয়া বিভাজন, পারস্য-আরব বৈরিতা এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল তাকে এক ঘোরতর একাকীত্বে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু আজ যখন ইসরাইল তার মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ করছে, তখন ইরানের প্রতিরোধচেতনা একটি বৈশ্বিক প্রতীক হয়ে উঠছে- যদিও এটি দুঃখজনকভাবে মুসলিম দেশগুলোর নয়, বরং ইরানের একক প্রতিক্রিয়া।
ইরান যদি একটি পশ্চিমা মিত্র দেশ হতো, তাহলে ইসরাইলের এই হামলাকে জাতিসংঘে ‘যুদ্ধাপরাধ’ ঘোষণা করা হতো। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের নীতিমালা শুধু শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানেই মুসলিম বিশ্বের দুর্ভাগ্য- তারা নিজেদের জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী এক বড় শক্তি হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে তুচ্ছ।

যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ফ্রান্স ইতিমধ্যে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের সময় তারা রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার জন্য দায়ী করেছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত ছিল এই দ্বিচারিতা তুলে ধরা এবং সম্মিলিতভাবে বিশ্ব ফোরামে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া- কিন্তু তারা তা করেনি।
এই প্রশ্নটি বারবার উঠে আসছে: মুসলিম উম্মাহ কি আদৌ কোনো বাস্তব কাঠামো? ওআইসি কি আজ সত্যিকার অর্থে কোনো কার্যকর সংগঠন? যদি ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও ইরান- সবখানে মুসলিমের রক্ত ঝরে, আর মুসলিম রাষ্ট্রনেতারা চুপ থাকেন- তবে এই উম্মাহ কি কেবল ধর্মীয় রোমান্টিকতাবাদে আবদ্ধ? সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে হয়তো একধরনের সহমর্মিতা রয়েছে, তারা বিক্ষোভ করেন, দোয়া করেন, তহবিল পাঠান। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিতে তার প্রতিফলন নেই।

মুসলিম বিশ্বের উচিত এখনই নতুন করে চিন্তা করা- কিভাবে একটি বাস্তব ও কার্যকর মুসলিম জোট গড়ে তোলা যায়। ওআইসিকে ঢেলে সাজাতে হবে, শুধুমাত্র বিবৃতিমুখী নয়, বরং সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সংগঠনে রূপান্তর করতে হবে। তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও কাতার- এই দেশগুলো মিলে একটি বিকল্প কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন করতে পারে, যেখানে যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান নেওয়া হবে।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না, হয়তো একসময় আন্তর্জাতিক চাপ বা মধ্যস্থতায় থেমে যাবে। কিন্তু ইতিহাসে তা থেকে যে শিক্ষা নেওয়ার দরকার, তা অনেক গভীর। মুসলিম বিশ্ব আজ অকার্যকর, নীতিহীন ও নিরুপায় এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে। এই দুর্বলতা শুধু বাহ্যিক নয়, এটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ঐক্যবোধ ও কৌশলগত দিশাহীনতার ফল। এখনই সময়- এই অনৈক্য, নির্লিপ্ততা ও আত্মঘাতী নীরবতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, মুসলিম উম্মাহকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার। না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক তেহরান, গাজা, বাগদাদ, বা দামেস্ক ধ্বংস হবে- আর আমরা শুধু শোক বার্তা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করব।
পাঠকের মতামত
ঐক্য ⁉️
ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্য হলে, কি হবে ❓
অতিরিক্ত ভোগবিলাস, মদ্যপান আর নৃত্যানন্দ কারণে ইতোপূর্বে বহুজাতী ধ্বংস হয়েছে। বর্তমানে এই আসক্তি চূড়ান্ত রুপ ধারণ করেছে। এটাই অনৈক্যের মূল।
মুসলমান? কোথায় মুসলমান, সব তো নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ!
মুসলিম বিশ্ব বলতে আসলে অবশিষ্ট কিছু নেই! সবই পা চাটা গোলাম! পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইরানে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার জালে আটকা! বাংলাদেশে যেমন সরকারি সংস্থা গুলো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার জালে আটকা পড়ে আছে! সেই ইসলাম ধর্মের যাত্রার শুরু থেকেই মোনাফেকরা নবী (সঃ) আশেপাশে ছিল এবং আল্ কোরআনে এই ব্যাপারে রাসুল সাঃ কে সতর্ক করা হয়েছিল! তাছাড়া মুসলিম শাসকরা আরাম প্রিয় এবং ব্যতিক্রম ছাড়া অসৎ!
Most of the Muslim countries are run by the "Munafiqs/Hypocrites. They don't dare to stand against injustice.
তেল সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো পারমানবিক বোমার চেয়েও বেশী ভয় করে গণতন্ত্রকে, রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনকে। পশ্চিমারা আরবদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের নাকে দড়ি লাগিয়ে যা ইচ্ছা তা আদায় করে নিচ্ছে। পশ্চিমারা আরব দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনা। তাই আরবদেরও পশ্চিমাদের প্রিয়।