শেষের পাতা
ময়নার জন্য কাঁদছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া
জাবেদ রহিম বিজন/ মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
৮ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার
এমন নৃশংস, পৈশাচিক ঘটনা শাহবাজপুরের ইতিহাসে আর ঘটেনি। হতবাক গ্রামের মানুষ। গোটা গ্রামই স্তব্ধ। কে এই পাষণ্ড? তার মুখ দেখতেই উদগ্রীব সবাই। তবে এখনো পুলিশ চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার কূলকিনারা করতে পারেনি। পৈশাচিক নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ছোট্ট শিশু ময়নাকে। মসজিদে পাওয়া যায় তার নিথর দেহ। মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই বর্বর এ হত্যার ঘটনা নিয়ে আলোচনা সবার মধ্যে। এ ঘটনায় কাঁদছে গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নিষ্পাপ এক শিশুকে কেন এভাবে হত্যা। কারা জড়িত এই হত্যাকাণ্ডে? সোমবার আসরের পর শাহবাজপুর খেলার মাঠে শিশু ময়নার নামাজে জানাজা হয়। এতে যোগ দেয় হাজার হাজার মানুষ। তাদের সবাই চান হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার। শাহবাজপুরের সাবেক ইউপি সদস্য, বিশিষ্ট সালিশকারক এ কে এম বাবুল হক বলেন-এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা শাহবাজপুরের ইতিহাসে নেই। আমরা সাংঘাতিকভাবে ব্যথিত। খুনিদের খুঁজে বের করে ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই আমাদের সবার দাবি।
ঘটনা রোববারের। এদিন সকালে ভয়ঙ্কর খবরে ঘুম ভাঙে শাহবাজপুরের মানুষের। নয় বছর বয়সী শিশু ময়নার লাশ পাওয়া যায় বাড়ির পাশের মসজিদের দ্বিতীয় তলায়। শনিবার বিকাল থেকেই সে ছিল নিখোঁজ। ময়না শাহবাজপুরের ছন্দু মিয়া পাড়ার বাহরাইন প্রবাসী আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে। সে লতিফ মোস্তারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় নূরানী বিভাগে পড়তো। নিহতের পরিবার জানায়, শনিবার দুপুরে ময়না বাড়ি থেকে খেলাধুলা করার জন্য বের হয়। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ময়নাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার মায়ের। সেই স্বপ্ন এমন নৃশংস বর্বরতম কাণ্ডের মাধ্যমে মিইয়ে যাবে তা ভাবেননি কখনো। ঘটনার পর থেকে ময়নার মা ও পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে কাঁপছে আকাশ বাতাস। এমন নিষ্ঠুর ঘটনায় স্তব্ধ তার নিজ গ্রাম সরাইলের শাহবাজপুরসহ গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। সহমর্মিতা ও সান্ত্বনা জানাতে ময়নাদের বাড়িতে ছুটে যাচ্ছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের লোকজন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ বিভাগসহ প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের লোকজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ন্যক্কারজনক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ বিচারের দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয় ও প্রবাসীরা। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছেন মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে। গতকাল ময়নার মা লিপি আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে সরাইল থানায় হত্যা মামলা করেছেন।
সরজমিন অনুসন্ধানে পুলিশ, পরিবার ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, শাহবাজপুর গ্রামের ৮ নম্বর ওয়ার্ড ছন্দু মিয়া পাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক মিয়া। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাহরাইন প্রবাসী। ৩ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে ময়না তৃতীয়। সন্তানদের সুখ-শান্তির জন্যই পরিবার ফেলে প্রবাসে জীবনযাপন করছেন রাজ্জাক। সুশ্রী সদা হাস্যোজ্জ্বল মায়মুনা জাহান ময়নাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল পরিবারের। পড়ালেখায় মেধাবী হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে খুবই আদরের ছিল ময়না। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ময়না বাড়ির পাশের মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগেও পড়াশুনা করতো। শনিবার বিকালে ময়না খেলতে বেরিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত আর বাড়ি ফিরেনি। যেখানে সন্ধ্যার পরই প্রাইভেট পড়তে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। সেখানে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফিরছে না। ময়নার মা সহ পরিবারের সকলেই চারদিকে খুঁজতে থাকে। আশপাশসহ দূর-দূরান্তের স্বজনদের বাড়িতেও সন্ধান মিলেনি ময়নার। অস্থিরতা বাড়তে থাকে ময়নার মা’র। গভীর রাত পর্যন্ত ময়নার কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। রাত ১টার দিকে সরাইল থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন ময়নার মা। রাতে ঠিকমতো ঘুমাননি কেউই। পরের দিন রোববার ভোরে তাদের বাড়ি থেকে ১০ গজ দূরে হাবলীপাড়া মসজিদের মক্তবে পড়তে যায় শিশুরা। তারা মসজিদের দ্বিতীয়তলায় ময়নাকে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পায়। বিষয়টি হুজুরকে জানায়। ইমাম সাহেব ময়নাদের বাড়িতে গিয়ে ময়নার মাকে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকা লাশের খবর দেন। সকলে মসজিদে এসে দেখেন দ্বিতীয়তলায় খাটিয়ার সঙ্গে বাঁধা ও গলায় পরনের সেলোয়ার দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় উপুর হয়ে পড়ে আছে শিশু ময়নার নিথর দেহ। রক্তাক্ত মুখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লালচে ও কালো দাগ। বাম পাশের গালের মাংস দেখা যায়। ময়নার মা পরিবার ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে সেখানকার পরিবেশ। শোকে কষ্টে নির্বাক ও স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা গ্রাম। সকলেই ধারণা করতে থাকেন শিশু ময়নার ওপর পৈশাচিক নির্যাতনের পর গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করেছে পাষণ্ডরা। ময়নার লাশ এক নজর দেখার জন্য গ্রাম, উপজেলা ও জেলা থেকে হাজার হাজার লোক ওই বাড়িতে ভিড় করেন। তারা এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। যাতে আর কেউ কোনোদিন শিশুর স্বপ্ন নষ্ট করার সাহস না পায়।’ পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ওই মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ থানায় নিয়ে যান। ময়নার মা লিপি আক্তারসহ পরিবারের ধারণা, শিশুটিকে ধর্ষণের পর গলায় সেলোয়ার পেছিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে পাষণ্ডরা। ময়না হত্যার বিচার দাবি করে মামলাটিতে শেষ পর্যন্ত বিনা ফিতে আইনি সহায়তা দিয়ে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সরাইল উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুরুজ্জামান লস্কর তপু।
থামছে না আহাজারি: নিহত ময়নার মা পরিবার ও স্বজনদের আহাজারি থামছে না। বুক ছাপড়িয়ে সর্বক্ষণ বিলাপ করছেন ময়নার মা লিপি আক্তার। সন্তানের অগণিত স্মৃতিচারণ করে চিৎকার করছেন। পৈশাচিক নির্যাতন ও হত্যার সময় সন্তানের কষ্টের কথা বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন। হত্যা ও নির্যাতনকারীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে উনার চোখের সামনে ফাঁসি দেয়ার দাবি করছেন প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে।
সর্বমহলে বিচারের দাবি: স্থানীয়দের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সহমর্মিতা জানাতে আসছেন ময়নাদের বাড়িতে। সকলেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ বিচারের দাবি করছেন। ফেসবুকে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ময়নার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিচার দাবি করছেন।
কাঁদছে শিক্ষক ও সহপাঠীরা: ময়নার নির্মম মৃত্যুতে কাঁদছেন লতিফ মোস্তারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ময়নার এমন মৃত্যু তারা কখনো কল্পনাও করেননি। প্রতিদিনের ক্লাসের সাথীর আকস্মিক বর্বর মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে পড়েছে সহপাঠীরা। ময়নার কথা জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে হোজাইফ মিয়া, আসিফা নুজহাত ও মো. নিশাত মিয়া। তারা বলেন, কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
মাদকের বিস্তৃতিকেই দায়ী করছেন অনেকে: ময়না হত্যাসহ গ্রাম এলাকায় চুরি, ছিনতাই আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয় উল্লেখ করেন অনেকেই। শাহবাজপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রাজিব আহমেদ রাজ্জি বলেন, ময়নার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তার পিতা- মাতাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের চারদিকে মাদক বিস্তৃতির ভয়াবহতা এমন সব কাণ্ডের জন্য অনেকটা দায়ী। আমার সন্তান দিনে রাতে কখন কোথায় যায়? কি করে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে গেল কিনা? সন্ধ্যার পর বাইরে কেন? এসব বিষয়ের জবাবদিহিতা নেয়া সকল অভিভাবকের দায়িত্ব। আমরা কি সেটা করছি?
জানাজায় মানুষের ঢল: ময়নার জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল। পিতার জন্য ১২ ঘণ্টা বিলম্বে ময়নার জানাজা হয়েছে। পিতা আব্দুর রাজ্জাক বাহরাইন থেকে আসছেন। এরপর জানাজা হয়েছে। গতকাল সোমবার বাদ আসর শাহবাজপুর খেলার মাঠে ময়নার জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল। জানাজায় অংশগ্রহণকারী সহস্রাধিক লোকের চোখেই ছিল অশ্রু।
ময়নার পিতা আব্দুর রাজ্জাক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার কলিজার টুকরা বুকের ধন যারা কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ বিচার চাই। পুলিশসহ সকল বাহিনীর কাছে আমার অনুরোধ দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করুন। এমন জঘন্য অপরাধীরা যেন কোনো ভাবেই রেহাই না পায়। তাদের ফাঁসি হলে আমার ময়নার আত্মা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।
ময়নার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোসা. লায়লা বেগম বলেন, ময়না অত্যন্ত মেধাবী ছিল। আগামীতে বৃত্তির জন্য তাকে প্রস্তুত করতে ছিলাম। একজন মেধাবী শিশু শিক্ষার্থী যদি এমন পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়। তবে আর মেধাবী বের হবে না। দেশ হয়ে যাবে মেধাশূন্য। পরিবার হারিয়েছে তাদের সন্তান। আর দেশ হারিয়েছেন ভবিষ্যৎ অমূল্য সম্পদ। এভাবে আর কতো ময়নাকে ইজ্জত ও প্রাণ দিতে হবে। আমরা দ্রুত ময়না হত্যার সর্বোচ্চ বিচার চাই। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, ইমাম- মুয়াজ্জিনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তদন্তও চলছে। মামলাটির তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই বলা যাবে না। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, বিষয়টি লোমহর্ষক, মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে খুবই গুরুত্বসহকারে কাজ করছেন। আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অপরাধীকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবেন।
পাঠকের মতামত
খুবই বেদনা দায়ক যে, বাবা-মা সন্তান হারিয়েছেন তাদের শান্তনা রাষ্ট্র কিভাবে দিবে। মাদকের সয়লাভ গ্রাম-মহল্লায়
ওই জানোয়ার বা জানোয়ার গুলোকে খুঁজে বের করা হোক। আকাশে,মাটিতে,সাগরে যেখানেই থাক ওকে খুঁজে বের করা হোক,ওর চেহারা দেখতে চাই।
দু একটা ফাসি মিডিয়া ও জনসমক্ষে দেন। এসব বন্ধ হবে