নির্বাচিত কলাম
হালফিল বৃত্তান্ত
আত্মসমীক্ষার দর্পণে মুক্ত গণমাধ্যম, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণতন্ত্র
ড. মাহফুজ পারভেজ
৭ মে ২০২৪, মঙ্গলবারবিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২৭ দশমিক ৬৪ স্কোর নিয়ে ২ ধাপ পিছিয়ে ১৬৫তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। বিশ্ব জুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) শুক্রবার (৩রা মে, ২০২৪) এই সূচক প্রকাশ করেছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিক দিয়ে এবার শীর্ষস্থান দখল করেছে নেপাল; ৬০ দশমিক ৫২ পয়েন্ট নিয়ে দেশটি ৭৪তম অবস্থান অধিকার করেছে। এর পরের অবস্থানে আছে মালদ্বীপ। ৫২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট নিয়ে দেশটি ১০৬তম অবস্থানে। এবারের তালিকায় প্রথম অবস্থান থেকে ছিটকে তৃতীয় স্থান পেয়েছে ভুটান। ৩৭ দশমিক ২৯ পয়েন্ট নিয়ে দেশটি ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানের পেছনে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আগের চেয়ে পিছিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সংঘাত ও কট্টর পরিস্থিতির দেশ আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো করেছে, আপাতত এটাই ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর রিপোর্টের মোদ্দা কথা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি বাংলা’ জানিয়েছে, একদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যদিকে গণমাধ্যমের মালিকানা করপোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াটা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সবমিলিয়ে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে ‘একটা ভয়ের পরিবেশ’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে, রাজনীতিবিদগণ, বিশেষত বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, দেশে যদি গণতন্ত্র না থাকে, একদলীয় শাসন কায়েম হয়ে থাকে, মুক্ত চিন্তা বিকাশের সুযোগ না থাকে, ১৮ কোটি মানুষকে যদি আওয়ামী লীগের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী একই লাইনে চলতে বাধ্য করা হয় সেখানে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা থাকে না। এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান।
সন্দেহ নেই, রাজনীতির স্থবিরতা ও গণতন্ত্রের অবক্ষয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মুক্ত সাংবাদিকতার গতি রুদ্ধ করে। কিন্তু এরই সঙ্গে যদি থাকে, যেমনটি বলছে ‘বিবিসি বাংলা’, গণমাধ্যমের মালিকানা কর্পোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা, তাহলে বিপদ আরও ভয়াবহ হতে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২ ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে আত্মসমীক্ষার দর্পণে সবগুলো কার্যকারণকেই সামনে আনা জরুরি। প্রকৃত কারণ চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা হলেই সমস্যার চরিত্রটি বোঝা যাবে এবং সমাধানসূত্র বের করাও সহজতর হবে।
এ কথা সত্যি যে, পেশাদার সাংবাদিকের নেতৃত্ব ও মালিকানার স্থলে ক্রমবর্ধমান হারে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিকানাধীন গণমাধ্যমে স্বাধীনতা ও মুক্ত সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করা দুরাশা মাত্র। মালিকানার চারিত্রিক বদলের কারণে, একটি-দুটি ছাড়া, অধিকাংশ পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম বুকে হাত দিয়ে বলতে পারছে না যে, তারা কোনো দলের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয়। সব মানুষের, সব মতের। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলাই তাদের একমাত্র সম্পাদকীয় নীতি। বিনয়ের সঙ্গে বলা দরকার যে, বর্তমান বাংলাদেশে ‘কারও প্রতি আমাদের রাগ বা বিরাগও নেই’, এমনটি বলার মতো সম্পাদক, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম সত্যিই দুর্লভ, ব্যতিক্রম অগ্রণী প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও তার ‘মানবজমিন’। তিনি অবিরাম বলছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো।’
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ মালিকেরই রয়েছে অপেশাদারি মনোভাব এবং সংবাদমাধ্যমকে ভর করে নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের সুপ্ত এজেন্ডা। নিজের বৈধ-অবৈধ ব্যবসার সংরক্ষণে মিডিয়াকে তারা চৌকিদার, পাহারাদারের মতো ব্যবহার করছেন। নিজের বা পরিবারের বা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বা আর্থিক অপকর্ম, অপরাধ ও দুর্নীতি আড়াল করার জন্য তারা এক বা একাধিক মিডিয়াকে মুষ্টিবদ্ধ করে অবাধে অপব্যবহার করছেন। এতে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে অবনতি হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে হচ্ছেও তাই।
মালিকানার ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ও পেশাদারিত্বের অভাবের সঙ্গে রয়েছে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত চাটুকারিতার বদ-মতলব। যার কারণে দায়িত্বশীল ও মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশ হচ্ছে না এবং সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও মুক্ত সাংবাদিকতা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে খুবই কম। বরং পাইকারি হারে তৈরি হচ্ছে বশংবদ ও তাঁবেদার। ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে’ সেইসব হাউজের কেউ কেউ অযাচিত সম্পদ ও পদের অধিকারী হচ্ছেন। এদের চেতনায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মুক্ত সাংবাদিকতার আদৌ কোনো উপস্থিতি নেই। মালিকের মতোই তাদের মগজের কোষে কোষে লাফাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের ধান্ধা। এদের ‘কর্তাভজা’য় লবেজান অবস্থা মুক্ত সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীন, নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা।
এমতাবস্থায়, ভয়ের পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী সংবাদকর্মীদের। কেননা, নতজানু আবহে স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের দমিয়ে রাখার হাতিয়ার হলো ভয়ের পরিবেশ। নীতি, নৈতিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রশ্নে মালিকের বিরুদ্ধে গেলেই চাকরি হারানোর বিপদ এসে হানা দিচ্ছে। পদে পদে আতঙ্কে থাকার মানসিক পীড়ন ও চাপ বাংলাদেশে মুক্ত সাংবাদিকতাকে গলা টিপে ধরেছে এবং ‘করপোরেট-রাজ’কে প্রবল থেকে প্রবলতর আকারে পেশাদার সাংবাদিকতার কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চাপিয়ে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারতো সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের লড়াই। ইউনিয়নগুলো সে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়ে পত্রিকা বা গণমাধ্যমের নীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? অতীতে তো হয়েছে। পাকিস্তানি কঠোর শাসনে এবং বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসনের নির্মমতার মধ্যেও সাংবাদিকদের আন্দোলন সফল হয়েছে। কিন্তু এখন তেমনটি হতে পারছে না। এর প্রধান কারণ বিভাজন ও রাজনৈতিক মেরূকরণ। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো এখন বিভাজিত। তীব্র রাজনৈতিক মেরূকরণে পরস্পরের চেয়ে দূরে তাদের অবস্থান। একদল সরকারপন্থি সাংবাদিক। অন্যদল বিরোধী দলপন্থি সাংবাদিক। উভয়েই তীব্র দ্বৈরথে লিপ্ত। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আকীর্ণ। এহেন পাকচক্রে নিপতিত হয়ে পেশাদার ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার চিড়েচ্যাপটা অবস্থা এবং সংখ্যায় যাদের বেশি থাকার কথা, তারাই হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক, কোণঠাসা, সংখ্যালঘু, অত্যল্প।
আলমগীর হোসেন আদি ইত্তেফাক-এ ইউনিট চিফ ছিলেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, পেশাদার ফোরাম যেমন ওকাব এবং অন্যান্য ইউনিয়নের সামনের কাতারের নেতা তিনি। অনলাইন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং বাংলাদেশের সিনিয়রমোস্ট পেশাদার সাংবাদিক ও সম্পাদকের একজন, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ অবনতিশীল পরিস্থিতির পটভূমিতে ‘পেশাদারিত্বের আবর্তে মুক্ত গণমাধ্যমের আকাঙ্ক্ষা’ জানিয়ে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের তথাকথিত অনেক সাংবাদিক নেতা ও স্তাবক সাংবাদিকরা এই মুক্ত সাংবাদিকতার পথকে রুদ্ধ করে ফেলেছেন। এখানে এত বেশি গ্রুপিং দেখা যাবে যে, বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে, এই কি তবে সাংবাদিকতা পেশার মান!’
তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘একসময় আমরা সংঘবদ্ধভাবে আমাদের অধিকারের প্রশ্নে ও সকল সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে পথে নামতাম। এখন কি সংঘবদ্ধভাবে নামার মতো অবস্থা আছে? দ্বিধাবিভক্তি আর ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের প্রবণতা এতটাই প্রকট যে, সাংবাদিকদের অনেককেই দেখি যারা এখন রীতিমতো রাজনৈতিক ক্যাডার বনে গেছেন! উদ্বেগের বিষয়, শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই এই ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাহলে কী করে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা হবে?’
আজকে কঠিন শোনালেও তার উপসংহার বাংলাদেশের সাংবাদিকতার উত্থান-পতনের ইতিহাস অন্বেষায় বিবেকের প্রতিধ্বনি স্বরূপ: ‘গাছের গোড়ায় পচন ধরলে যেমন উপরে পচন ধরে, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এটি আজ প্রযোজ্য। সে কারণে মুক্ত সাংবাদিকতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব করতে সর্বাগ্রে আমাদের নিজেদের শুদ্ধ করা জরুরি। সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা উন্নত করতে না পারলে মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যাবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ কিংবা সমাজ ও রাজনীতির দায়বদ্ধতার চেয়েও এটি জরুরি।’
সাংবাদিকতা পেশার অবক্ষয় ও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের পতনে সরকার বা বিরোধী দলের কিছু রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতি হবে নিশ্চয়ই। তবে এমনই ঘোরতর বিরূপ পরিস্থিতিতেও ক্ষমতা ও কর্তৃপক্ষের ধামাধরা সাংবাদিকদের পদ-পদবি, আর্থিক স্ফীতি ঘটে চলবে। কষ্ট পাবেন প্রকৃত সাংবাদিক ও পেশাদারিত্বের প্রতি আপসহীন ব্যক্তিত্বগণ। জীবনব্যাপী সাংবাদিকতার মর্যাদা সমুন্নত রাখার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে তাদেরকেই।
সম্ভবত এটাই ঐতিহাসিক নিয়তি। নিয়তির নির্বন্ধে কেউ কেউ আত্মস্বার্থের প্রলোভনে আপসের চোরাবালিতে বিলীন হবেন। কেউ কেউ লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলবেন। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২৭ দশমিক ৬৪ স্কোর নিয়ে ২ ধাপ পিছিয়ে ১৬৫তম অবস্থানে বাংলাদেশের অবনতি হলেও ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য দেবে যে, দালালি, দলবাজি, স্তাবকতা, আখের গোছানোর মতলবি মালিক ও সাংবাদিকদের অপকর্মের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়ে পেশাদারিত্বের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৎ, দায়িত্বশীল, বস্তুনিষ্ঠ, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য লড়াই করেছেন অনেকেই। বিরূপতার মধ্যেও তারা প্রমাণ করেছেন, করপোরেট ও কর্তৃপক্ষ যত বড় ও শক্তিশালী হোক না কেন, মিডিয়া তার পেশাদারিত্বের মাধ্যমে সেই দুষ্টচক্রকে ভাঙতে ও সত্য উচ্চারণ করতে পারে। তাদের প্রচেষ্টা গণমাধ্যমের শক্তিবৃদ্ধির পথে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বেগবান করছে এবং সর্বপ্রকারের অন্যায়, অপকর্ম ও কর্তৃত্ববাদী অপশক্তির বিনাশের পথ দেখিয়েছে। জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও সাধনায় তারাই ধারণ, লালন, পালন ও প্রমাণ করেছেন এই শাশ্বত সত্য: গণতন্ত্র রক্ষার মূল কবজ মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতা। তারাই পোস্ট-ট্রুথ, পোস্ট-মডার্ন, নিওলিবারেল বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের অধীন সংকুল বাংলাদেশের রিয়েল হিরো। তাদেরকে লাল সালাম।
লেখক: প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)