নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
কোটা ও প্রশ্নফাঁস, শিক্ষার্থীরা কি আজ কানাগলিতে?
বদরুল হুদা সোহেল
১৪ জুলাই ২০২৪, রবিবারদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রতিটি ছাত্রের প্রথম পছন্দ বিসিএস। যে যাই বলি, ধনী-গরিব নির্বিশেষে এই একটি মাত্র পরীক্ষাকেই শিক্ষার্থীরা আজ সফলতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রের গ্রামে থাকা অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বাবাও বিসিএস কী তা জানেন। একারণেই প্রত্যহ তিনি ছেলেকে বিসিএস বিসিএস বলে পড়ায় মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। প্রশ্নফাঁসের এই অনৈতিক ও অবৈধ বেড়াজালে কোনো বাবার স্বপ্ন আটকে যেতে দেয়া যায় না।
দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সরকারের পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তার ভেতর-বাহির নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমগুলো জনমনে দুর্নীতি প্রশ্নে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিল। সরকারি উচ্চ পদে পেশাগত দায়িত্বে থাকাকালীন দুর্নীতির লোমহর্ষক এসব ঘটনা যেন মুদ্রার একপিঠ। মুদ্রার ওপিঠে ওই সকল পদ-পদবিতে ঢোকার প্রাথমিক প্রবেশদ্বার হিসেবে পিএসসি’র যে আরেক অধ্যায় রয়েছে তা চিহ্নিত করেছে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। এ অধ্যায়টির রকমফের নিয়ে আলোচনা করার আগে দেশের উচ্চ শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু না বললেই নয়।
পরতে পরতে যখন দুর্নীতির একটা একটা করে প্রমাণ মিলছে ঠিক তখনই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘প্রত্যয় স্কিম’ প্রত্যাখ্যান মর্মে সরকার ও জনগণের চোখ পড়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতি কর্মসূচির উপর। এ আন্দোলন সরকারকে এতটা নাড়া দিতে না পারলেও আন্দোলনের কয়েকদিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা চলতি মাসের শুরু থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। কোটা বিরোধী আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র ক্লাসরুম ছেড়ে এখন রাজপথে। অতীতেও দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও ছাত্রআন্দোলন হয়েছে। এ দফায় উদ্দেশ্য বা কারণ ভিন্ন হলেও উচ্চ শিক্ষাস্তরে দেশে মূলত এখন ছাত্র শিক্ষকের এক যুগপৎ প্রতিবাদ চলছে। ছাত্র-শিক্ষকের যে সময় ক্লাস, পড়া বা পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সে সময় তারা মাঠে ময়দানে আর রাজপথে। দেশের উচ্চ শিক্ষার যে এখন নাজেহাল অবস্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেশনজটমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের যে বার্তা শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসছিলেন তা ফের মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কায়। ২০১৮ সালে এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরকার বাধ্য হয়ে দেশের ১ম ও ২য় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল করে। ২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্তির ঘোষণার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫৬% কোটা সংরক্ষিত ছিল। সম্প্রতি আদালতে কোটা সংক্রান্ত এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা এখন আন্দোলনরত। পূর্বের ন্যায় কোটার প্রচলন থাকলে মেধাবীরা যে মেধাহীনদের সঙ্গে চাকরির দৌড়ে পেছনে পড়বেন তার হিসাব যখন তারা সরকার বা রাষ্ট্রকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে যাচ্ছিল ঠিক তখনি বিসিএসের প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেসরকারি টিভি ‘চ্যানেল ২৪’ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করলো তা নিশ্চিতভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আরেকটি বড় চপেটাঘাত। টিভি চ্যানেলটি কয়েকপর্বে পিএসসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রশ্নফাঁস সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আরও তথ্য প্রকাশ করবে বলেও ইঙ্গিত দিলো এবং এ মর্মে চ্যানেলটি নিশ্চিত করলো যে এ সংক্রান্ত যথেষ্ট প্রমাণাদি তাদের হাতে রয়েছে।
টিভি চ্যানেলটি গত ৭ই জুলাই প্রাথমিক এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সিভিল সার্ভিসসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আনে। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাসহ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ৫১৬টি পদের পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে বলে চ্যানেলটি দাবি করে। রিপোর্টটিকে আমলে নিয়ে ইতিমধ্যে পিএসসির দুই উপ-পরিচালক ও এক সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অতীতে প্রশ্নফাঁস রেকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে অভিযুক্ত পিএসসি’র এক সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। নিতান্ত ড্রাইভার নিশ্চয়ই এত ক্ষমতাধর নয় যে, কারও সহযোগিতা ছাড়া একার পক্ষে এই দুর্ধর্ষ কাজটি করা সম্ভব। প্রশ্নফাঁস নিয়ে ড্রাইভারের স্বীকারোক্তিমূলক একটি ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্নফাঁসের রমরমা ব্যবসা না করলে কোটি কোটি টাকা সে পায় কোথা থেকে? এই ড্রাইভারের হাত ধরে কেউ বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে পিএসসি এ ব্যাপারে কী বলবে? প্রশ্নফাঁসের ঘটনা যদি সত্য হয়, তাহলে এই দুঃসাধ্য কাজটি করার জন্য তার সঙ্গে পিএসসির উপর মহলের কারও না কারও যোগসাজশ ও ইশারা-ইঙ্গিত ছিল। করোনাকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার মালেকের নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামানোর ঘটনা এখনো কেউ ভুলতে পারেনি। ড্রাইভার মালেক-আবেদ চক্রে সরকারি দপ্তরের আরও কোনো ড্রাইভার যুক্ত আছে কিনা তা তদন্ত করা দরকার।
এসব অভিযোগের সত্যতা মিললে এর দায় হিসেবে পিএসসি কী ধরনের মাশুল দিবে? চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণ বা জেলে পুড়ে দিলেই কি ঘটনা শেষ? সর্ষের ভেতরে যদি ভুত থাকে তাহলে সে ভুত তাড়ানোর কাজটি কে করছে? পিএসসি প্রশ্নফাঁস রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পিএসসি পরিবারের বাইরে থেকে (দুদক বা গোয়েন্দা সংস্থা) কোনো সদস্য যেহেতু কমিটিতে রাখা হলো না, সেহেতু তদন্ত প্রতিবেদনের উপর জনগণের আস্থা নাও থাকতে পারে!
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সম্ভবত এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার উপর ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকসহ দেশের আপামর জনসাধারণের একটা ভরসা ও আস্থা রয়েছে। সরকারি উচ্চপদে প্রবেশ হওয়ার ফিল্টার হিসাবে কাজ করে পিএসসি। এখন পর্যন্ত এটিই হলো চাকরিপ্রার্থীদের আশার প্রদীপ। এই প্রদীপের নিচের অন্ধকারে যদি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে তাহলে বেকার শ্রেণি যাবে কার কাছে? মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের বোকার স্বর্গে রেখে অমেধাবী, অদক্ষ ও অযোগ্যদের সরকারি চাকরিতে নির্বাচিত করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, দুর্নীতির যে চিত্র আজ আমরা দেখছি তা অক্টোপাসের মতো চারপাশ থেকে দেশকে আটকে ধরবে। পিএসসির দিকে যেহেতু অনিয়মের আঙ্গুল উঠেছে, সেহেতু পিএসসি’র এখন নিজেকে কলঙ্কমুক্ত হিসেবে প্রমাণ করা দরকার। তা না হলে সামনে আরও কিছু সমস্যা বা প্রশ্ন তৈরি হবে। যেমন- যারা আগামীতে পিএসসি’র বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে দিনরাত পড়াশোনা করছেন তাদের মনে অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা বাসা বাঁধবে। কোন আশায়, কোন ভরসায় তারা কষ্ট করবেন? অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন পেয়ে সোনার হরিণ নামক সরকারি চাকরিটা হাতিয়ে নিয়ে তারা যদি দেশ বা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করে তাহলে দুর্নীতিমুক্ত দেশগড়ার স্বপ্ন সরকার কাদের নিয়ে দেখছে?
দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রতিটি ছাত্রের প্রথম পছন্দ বিসিএস। যে যাই বলি, ধনী-গরিব নির্বিশেষে এই একটি মাত্র পরীক্ষাকেই শিক্ষার্থীরা আজ সফলতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রের গ্রামে থাকা অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বাবাও বিসিএস কী তা জানেন। একারণেই প্রত্যহ তিনি ছেলেকে বিসিএস বিসিএস বলে পড়ায় মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। প্রশ্নফাঁসের এই অনৈতিক ও অবৈধ বেড়াজালে কোনো বাবার স্বপ্ন আটকে যেতে দেয়া যায় না।
সততা-সুশাসন চর্চা ও প্রতিষ্ঠার জন্য পিএসসি এখন বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সিলেবাসে ‘নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন থাকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায়। প্রশ্ন হচ্ছে, পিএসসি যেহেতু নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসনকে গুরুত্ব দিয়েছে তাহলে পিএসসি নিজেই যে এই গুণগুলোর ধারক ও বাহক তা স্পষ্ট করতে হবে। স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এই কমিশনের। স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে প্রশ্ন প্রণয়ন ও নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনার দীর্ঘ সুনামের কারণে অন্যান্য সকল নিয়োগ পরীক্ষা পিএসসি’র অধীনে নেয়ার একটি প্রচ্ছন্ন দাবিও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে। পিএসসি যদিও গত ৮ই জুলাই এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়ে তাদের বক্তব্য ও অবস্থান ষ্পষ্ট করেছে, তবুও এ স্বাধীন সংস্থার উপর জনসাধারণের যেন কোনো আস্থার সংকট সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে পিএসসিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কোটা পদ্ধতির পিছুটান ও প্রশ্নফাঁসের সন্দেহ নিয়ে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম কোনো কানাগলিতে প্রবেশ করুক তা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ।