ঢাকা, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার, ২২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের চালিকাশক্তি জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক ঐকমত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ
১১ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবারmzamin

ফলে ‘জাতীয় ঐক্য’ থেকে ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ সম্পন্ন হলে সকলেই লাভবান হবেন এবং দেশের স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকবে। সরকার চাপ ও বিরক্তিহীনভাবে কাজ করতে পারবে। সরকারের ভেতর আগে বা বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্তগণ এবং সরকারের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা ঠিক মতো কাজ করছে, নাকি অতীতের মতো গোষ্ঠীবাদ ও দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত হচ্ছে, তা নিরীক্ষা করতে পারবে। কিংবা স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক সরকারের ধামাধরা সেজে প্রতিপক্ষকে দুর্নীতির নামে মামলা ও অন্যবিধ পন্থায় নাজেহাল করা হচ্ছে কিনা, সেটাও পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হবে।

বর্তমান বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি কে বা কারা? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে উল্লেখ করা দরকার, যেকোনো রাষ্ট্রের, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে কোনো সরকারের একটি মূল চালিকাশক্তি থাকে। আর তা হলো ক্ষমতাসীন দল ও সে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশ্বের সকল দেশেই এমনটি হয়। সাধারণত রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে যেহেতু বর্তমানে কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় নেই, সেহেতু বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তির আসনে কোনো রাজনৈতিক দল ও তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব আসীন নেই। তাহলে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকারের মূল চালিকাশক্তি কে বা কারা? এটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। বিশেষত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক পরিসরে ক্ষমতাকাঠামো বা পাওয়ার স্ট্রাকচার নিয়ে যে আলোচনা হয়, তাতে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ক্ষমতার বিন্যাস দৃশ্যমান হয়। এ বিষয়টি মোটেও গোপন কিছু নয়। বিশ্বের সকল দেশেই প্রকাশিত বিষয়।

জুলাই-আগস্টের বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ বর্তমানে তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নয়, তিনটি অরাজনৈতিক স্তম্ভ পরিবর্তিত বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি হয়ে কাজ করছে এবং নির্দলীয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই তিন স্তম্ভের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংস্কারের পথে শুদ্ধতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের লক্ষ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটাই বাস্তবতা।
বাংলাদেশের তিন চালিকাশক্তির সর্বাগ্রে রয়েছে ছাত্রদের নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করে বৈষম্য মুক্তির পথ রচনা করেছে। ছাত্র আন্দোলন রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের আশা নিয়ে এসেছিল এবং এখনো সে আশা পূরণ করার লক্ষ্যে বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে নতুন দিনের প্রত্যয়ে সংগ্রাম করে চলেছে।

বর্তমান বাংলাদেশের আরেক প্রধান চালিকাশক্তি হলেন ড. ইউনূস। যার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, দক্ষতা ও ভাবমূর্তির ওপর আস্থা রেখেছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। যে আস্থার ছাপ বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যবিরোধী জনতার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। একইসঙ্গে ড. ইউনূস পুরো বিশ্বকে তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ও বিশ্বাসী করতে সক্ষম হয়েছেন। সমগ্র বিশ্ব তার নেতৃত্বকে নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং নানা ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছে।

তৃতীয় যে চালিকাশক্তি বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করেছে, তা হলো দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী। বিশেষত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর দেশ যখন শৃঙ্খলাহীন এক গভীর শূন্যতা ও নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছিলো, তখন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশকে সংঘাত ও হানাহানি মুক্ত করেছে, নাগরিকদের জানমালের হেফাজত করেছে এবং দেশের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করেছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে সেনাবাহিনীর অবদান মানুষের আস্থা অর্জন করেছে।

এই তিন চালিকাশক্তিই বর্তমান বাংলাদেশের মূল স্তম্ভ স্বরূপ। যাদের সমগ্র দেশবাসী, রাজনৈতিক দল ও সিভিল সমাজ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। আর এই তিন চালিকাশক্তিই বিদ্যমান সংকুল পরিস্থিতির শত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে স্বৈরাচারের ধ্বংসস্তূপ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের এই তিন মূল স্তম্ভ বা চালিকাশক্তি কিন্তু সম্পূর্ণভাবে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের বাইরে অবস্থান করছে। এদের যাবতীয় কার্যকলাপ ও পদক্ষেপের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জাতীয় স্বার্থ ও জনস্বার্থ। ফলে এদের দলীয় রাজনীতির দড়ি টানাটানির বিষয় তথা প্রতিপক্ষ বানানোর কোনো সুযোগ নেই। এদেরকে প্রতিপক্ষ ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা মানে হলো- বর্তমান বাংলাদেশের মূল স্তম্ভ তথা চালিকাশক্তিকে আঘাত করা, যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে আঘাত করার শামিল। তাই বর্তমান সরকারের সঙ্গে সকলের আলাপ-আলোচনা ও দেন-দরবার চলতে পারলেও বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে উপনীত হওয়ার সুযোগ নেই।  যদিও মাঝেমধ্যে মনে হয় যে, সরকারের সঙ্গে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলেও ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। যা মোটেও কাম্য নয় ও দ্রুত নিরসনের বিষয়।

জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া বাকি সকল রাজনৈতিক শক্তির সম্মতি ও সমর্থনের মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তার পেছনে সকলের সমর্থন ও সহযোগিতার বিষয়টিকে ‘সাধারণ ঐকমত্য’ বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু যেহেতু ঐকমত্য একটি রাজনৈতিক বিষয়, তাই এক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে সাধারণ ঐকমত্যের স্তর পেরিয়ে বৃহত্তর ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। এমনটি হলে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশের উত্তরণ মসৃণ ও বাধাহীন হবে।

সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশে এখন জাতীয় ঐক্যের ডাক শোনা যাচ্ছে। জাতীয় ঐক্য যে প্রয়োজন- সেটা স্পষ্ট। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান তো দুর্নীতিবাজ-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জাতীয় ঐক্যেরই জয়। তবে তা ছিল সাময়িক ও তাৎক্ষণিক ঐক্য মাত্র। স্থায়ী, যথার্থ ও কার্যকর ঐক্যের জন্য প্রথম বিবেচ্য হলো রাজনৈতিক টার্গেট নির্ধারণ করার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে রাজনৈতিক ঐক্যে পর্যবসিত করা।

‘জাতীয় ঐক্য’ থেকে ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ সাধন করা সম্ভব হলে সংস্কার, পরিবর্তন, সরকারের সময়কাল, পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে বাকবিতণ্ডা হওয়ার অবকাশ থাকবে না। সরকার কতোদিন ক্ষমতায় থেকে কতোটুকু সংস্কার কাজ করবে, সেটাও রোডম্যাপ আকারে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো নেতাকে নানা ইস্যুতে চাপ দিয়ে কথা বলতে হবে না এবং সরকারও নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সাধারণ মানুষও সরকার আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির শিকার হবে না।

ফলে ‘জাতীয় ঐক্য’ থেকে ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ সম্পন্ন হলে সকলেই লাভবান হবেন এবং দেশের স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকবে। সরকার চাপ ও বিরক্তিহীনভাবে কাজ করতে পারবে। সরকারের ভেতর আগে বা বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্তগণ এবং সরকারের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা ঠিক মতো কাজ করছে, নাকি অতীতের মতো গোষ্ঠীবাদ ও দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত হচ্ছে, তা নিরীক্ষা করতে পারবে। কিংবা স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক সরকারের ধামাধরা সেজে প্রতিপক্ষকে দুর্নীতির নামে মামলা ও অন্যবিধ পন্থায় নাজেহাল করা হচ্ছে কিনা, সেটাও পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হবে।

‘জাতীয় ঐক্য’ থেকে ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ সাধিত হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি মজবুত ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পাবে। দলের নামে দখলবাজি ও চাঁদাবাজি রোধ করে দলে শৃঙ্খলা আনতে সচেষ্ট হবে।
জনগণ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তামুক্ত হবে এবং দেশের স্থিতিশীলতাও দৃঢ়তর হবে। সর্বোপরি, ‘জাতীয় ঐক্য’ থেকে ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ নিশ্চিত হলে দেশ ও বিদেশ থেকে বাংলাদেশকে বিব্রত ও বিরক্ত করা কোনো দৃশ্যমান ও অদৃশ্য শক্তির পক্ষে আর সম্ভব হবে না। ফলে শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মৌলিক বিষয়ে ‘জাতীয় ঐক্য’ ও ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।

লেখক: প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status