প্রথম পাতা
মার্কিন শুল্ক
শঙ্কায় মালিক শ্রমিকরা
স্টাফ রিপোর্টার
৬ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বড় অঙ্কের নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণায় বিশ্ব জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আগামী ৯ই এপ্রিলের মধ্যে ট্রেড ব্যালান্স না করলে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য মার্কিন আমদানিকারকদের ৩৭ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। এতদিন এ শুল্কের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। নতুন আরোপিত এ শুল্কহার বাস্তবায়ন হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামগ্রিক অর্থনীতি। তাই সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুল্ক কমানো ও কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতিতে শ্রমঘন বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন মালিক-শ্রমিকরা। ঢাকার অদূরে টঙ্গী, আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর ও শিল্প এলাকায় মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও শঙ্কা লক্ষ্য করা গেছে। ঈদের ছুটিতে বেশির ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও সরজমিন ঘুরে গার্মেন্টস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) সহ অন্য খাত সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো শুল্ক ঘোষণার পরপরই সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, মার্কিন সরকার যে ভাষায় কথা বলছে, আমাদেরও সে ভাষায় উত্তর দিতে হবে। যেমন তারা ট্রেড ব্যালান্সের কথা বলছে। আমেরিকায় তুলার বাজার আছে, ভোজ্য তেল, গম, বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যসহ বাংলাদেশের বাজারে চাহিদা আছে এমন পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার সুযোগ করে দিতে হবে। এতে বাংলাদেশের বাজারেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে বাণিজ্য সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়েছে। আমাদেরও বিলম্ব না করে সরকারি উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে।
বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেছেন, মার্কিন সরকার বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর ৩৭ শতাংশ কর আরোপ করেছে। এটা আমাদের কাছে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে। এখন তাৎক্ষণিক সমাধান হলো আমাদের সরকার ধীরে ধীরে তাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডিউটি কমিয়ে দিতে পারে। এটা করলে আমাদের ক্ষতি নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের আমদানির চেয়ে রপ্তানি অনেক বেশি। তাই যতটুকু আমদানি হচ্ছে সেখানে সরকার যদি ডিউটি কমিয়েও দেয় এর প্রভাব খুব একটা হবে না। এটা একটা সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন হাতেম।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল আলম বলেন, আমেরিকা থেকে আমাদের রপ্তানি আয় মোট আয়ের এক-পঞ্চমাংশ হলেও একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে অনেক বেশি কৌশলী হতে হবে বাংলাদেশকে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখতে কূটনৈতিক চ্যানেলে তৎপরতা চালাতে হবে। সরকারের উচিত- কূটনৈতিক চ্যানেলে সঠিক তথ্য তাদের সামনে তুলে ধরা। সরকারকে শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন শুল্ক প্রত্যাহারে রাজি করানোর আহ্বান জানান। তা না হলে, আমাদের পোশাক খাত ভয়াবহ সংকটে পড়বে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কড়াকড়ির কারণে নতুন বাজার তৈরির দিকেও মনোযোগী হবেন রপ্তানিকারকরা।
শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক কমানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি ও জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখে। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি কর্মরত।
দেশের একজন গার্মেন্টস রপ্তানিকারক ও বিজিএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম জানান, তার প্রতিষ্ঠানটি উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে পোশাক সরবরাহ করে থাকে। এখানে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কর্মী কাজ করেন। হঠাৎ শুল্ক আরোপের ফলে অনেক অর্ডার (ক্রয়াদেশ) বাতিল হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক মূল্য সুবিধা হারাতে পারে। বাংলাদেশকে এখন কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা বাড়ানো।
বিজিএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি এবং রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নিয়ে উদ্বেগের কারণ আছে। ভারত ও পাকিস্তানে কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) জানুয়ারি পর্যন্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে চীনের দাপট একচেটিয়া। চীনের হিস্যা ২১ শতাংশ। বাংলাদেশের হিস্যা ৯ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ১০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। চতুর্থ অবস্থানে ইন্দোনেশিয়া এবং পঞ্চম ভারত। শীর্ষ দশের বাকি ৫ দেশ যথাক্রমে মেক্সিকো, হুন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭২০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা ওই বছরের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশ। অন্যান্য পণ্য মিলে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানি হয় ৮৫০ কোটি ডলারের পণ্য।
উদ্বেগ গার্মেন্ট পল্লীতে
শ্রমঘন বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন মালিক-শ্রমিকরা। ঈদের ছুটিতে বেশির ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও মালিক-শ্রমিক উভয়ের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে। টঙ্গীর একটি মাঝারি মানের কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা মূলত যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করি। এই শুল্ক কার্যকর হলে আমাদের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী মার্কেট ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। বিদেশি ক্রেতারা তখন হয় চীন বা ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকবে, নয়তো অর্ডারই কমিয়ে দেবে।
টঙ্গী ব্রিজ এলাকায় কথা হয় শ্রমিক রুবিনা আক্তারের সঙ্গে। টঙ্গীর একটি কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, কারখানায় কাজ করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালাই। যদি অর্ডার কমে যায় আর কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কীভাবে সংসার চালাবো? খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিক আরিয়ান রমজান বলেন, ঈদের আগে আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদের পর চাকরির জন্য চেষ্টা করবো ভাবছি। কিন্তু সব জায়গায় এখন আলোচনা হচ্ছে ট্রাম্পের এই শুল্ক নিয়ে। গার্মেন্টস শিল্প আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এর সুযোগ সুবিধা বজায় রাখতে সরকারকে সচেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে।
একেএস গার্মেন্টস মালিক কাসেম বলেন, এ শুল্ক আরোপের ফলে আপাতত কোনো সমস্যা না হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে অর্ডার কম আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে বেশি দামে পোশাক ক্রয় করতে হবে। ফলে তারা কম পণ্য কিনবে। গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের আইন বিষয়ক সম্পাদক একেএম মিন্টু মনে করেন বাংলাদেশ সরকারকে শুল্ক কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
রাইজিং গ্রুপের জিএম তৌহিদের মতে, শুল্ক যেহেতু ১৫ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশ হয়েছে তার প্রভাব তো অবশ্যই পড়বে।
পাঠকের মতামত
মালিকদের কি সমস্যা? শ্রমিকরাইতো ভিখারি হবে।