প্রথম পাতা
ঢাকার দুই সিটির মশার পেটে ৮২৭ কোটি টাকা
শুভ্র দেব
৯ এপ্রিল ২০২৫, বুধবারমশা নিধনে প্রতি বছরই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বড় অঙ্কের বাজেট করে আবার সেটি খরচও করে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও দৃশ্যমান কোনো উপকার আসে না। বছরের পর বছর শুধু অর্থেরই অপচয় হয় কিন্তু ঢাকাবাসীর মশার কামড়ের দুর্ভোগ যেন আর শেষ হয় না। এডিস মশার কামড়ে শত শত মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে থেকে অনেকেই না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু একটা আতঙ্কের নাম হয়েছে। তবে মশা নিধনে সিটি করপোরেশনগুলো যেসব কর্মসূচি নিচ্ছে, সেগুলোর কোনো কার্যকারিতা নেই। নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে গত ১০ বছরে দুই সিটি করপোরেশন বাজেট করেছে প্রায় ৮২৭ কোটি টাকা। ওষুধ ও সরঞ্জামাদি ক্রয়সহ নানা খাতে এই বাজেট খরচ করেছে। কিন্তু কোনো বছরই নগরবাসীরা স্বস্তিতে ছিলেন না। বরাবরই মশা নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
শুধু কীটনাশক দিয়ে মশা নিধন নয়। এর সঙ্গে সিটি করপোরেশন ভিন্ন ভিন্ন বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। ১০ বছরে দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারতে কীটনাশক ক্রয়ের পাশাপাশি ড্রেনে তেলাপিয়া মাছ, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশক নিধনের এবং ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎসস্থল চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ কীটতত্ত্ববিদদের মতে, মাছ-ব্যাঙ-হাঁস মশা নিধন করতে পারে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। শুধুমাত্র গাপ্পি মাছ দিয়ে মশা নিধন কার্যকরী হলেও সেই মাছ ছাড়ার কিছুদিন পর মনিটরিংয়ের অভাবে মারা যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত দিনে ঢাকার মেয়ররা মশা মারার বাজেট করতে দুই মেয়র যত উৎসাহী, মশা মারতে তত আগ্রহী ছিলেন না। মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়া ও নগরবাসীর ভোগান্তি বেড়ে গেলে দুই সিটি নড়েচড়ে বসে। তখন নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ভিন্ন কিছু উদ্যোগও নেয়। এ ছাড়া, সচেতনতামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করে। কিন্তু দিনশেষে মশা নগরবাসীর জন্য অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে মশার উপদ্রব বেড়েছে নগর জুড়ে। সামনে বৃষ্টি-বর্ষার মৌসুমে মশার উপদ্রব আরও বাড়বে। এখন দুই সিটিতে মেয়র নাই। সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে দুই সিটির কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রশ্ন উঠেছে- মেয়ররা মশক নিধনে ব্যর্থ হয়েছেন। দুই প্রশাসক মশক নিধনে কতোটুকু গুরুত্ব দেবেন।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, দুই সিটি প্রতিবছর বড় অঙ্কের বাজেট করে। ওষুধ ছিটানো, ফগিংসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু ফলাফল আসে না মনিটরিংয়ের কারণে। মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদেরকে মনিটরিং করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় না। মূল্যায়ন সভা করে ব্যর্থতা পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এ ছাড়া, শুধুমাত্র কীট নির্ভর মশক নিধন পদ্ধতির কারণেও সফলতা আসছে না। তাই বিজ্ঞানসম্মতভাবে মশক নিধনের উপর জোর দিতে হবে। যদি সিটি করপোরেশনগুলো বরাবরই ব্যর্থতাকে আড়াল করে তাদের সফলতার গুণগান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশক নিধনের জন্য বাজেট করা হয় ১২ কোটি ৫০ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কিছুটা কমিয়ে বাজেট করা হয় ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ ও ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা বাজেট করা হয়। এ হিসাবে গত ১০ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটিতে ২৬৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বাজেট করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশক নিধনে বাজেট করা হয় ১৪ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১১ কোটি ৯৫ লাখ)। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয় ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৬ কোটি ৮৫ লাখ)। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭ কোটি ৫০ লাখ)। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি (সংশোধিত বাজেট ১৭ কোটি ৫০ লাখ), ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ (সংশোধিত বাজেট ৫৮ কোটি) ৭০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫০ কোটি ৫০ লাখ), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫৩ লাখ), ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৬ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫২ কোটি ৫০ লাখ), ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৮৪ কোটি ৫০ লাখ (সংশোধিত বাজেট ৮৭ কোটি ৫০ লাখ) ও ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাজেট করা হয় ১১০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে উত্তর সিটিতে গত ১০ অর্থবছরে ৫৬১ কোটি টাকার বেশি বাজেট করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন মানবজমিনকে বলেন, সামনে যদি মশার উপদ্রব বাড়ে তবে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেবো। আমাদের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে তাদেরকে দিয়ে মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ানো হবে। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তারা ঠিকমতো মশার ওষুধ যাতে প্রয়োগ করে সেজন্য এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মশার ওষুধ নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, যে মেডিসিন সংগ্রহ করা হয় সেটি আগে পরীক্ষা করা হয় তারপর ব্যবহার করা হয়। কাজ না করলে ফেরত দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা করার পর যদি রেজাল্ট ৯০ শতাংশের উপরে আসে তবেই ব্যবহার করা হয়। মশার উপদ্রব নিয়ে তিনি বলেন, মশা তো একদমই চলে যাবে না। আমি নিজেও দক্ষিণ সিটি এলাকায় থাকি। সেখানে মশা দেখি না। তবে কিছু কিছু এলাকা আছে সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। নিচু এলাকা, পানি জমে থাকে এসব এলাকায় মশা থাকে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, মূল ব্যর্থতা হলো মনিটরিংয়ে। কোনো কাজ বা প্রজেক্ট যদি সঠিকভাবে মনিটরিং না করা হয়, তবে তার ফল ভালো আসে না। মাঠে যারা মশক কর্মী কাজ করে তারা ঠিকমতো কাজ করছে কি না সেটা যদি মনিটরিং করা না হয় তবে মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না। সিটি করপোরেশনকে ফোন দিলে বলবে আমরা সব কাজই করছি। তাহলে ফলাফল কেন আসছে না? এটা বের করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আমি এত কোটি টাকা খরচ করছি তাহলে কেন ফলাফল আসছে না। তাহলে আমি কেন খরচ করছি? খরচ করার পরও যদি ফলাফল না আসে তবে মনিটরিং রিপোর্ট বের করতে হবে। মনিটরিং রিপোর্ট ধরে দুই মাস পরপর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মূল্যায়ন সভা হওয়ার কথা। আমরা এত টাকা খরচ করেছি, এত জনবল দিয়েছি কিন্তু ফলাফল আসেনি। ভবিষ্যতে কি করতে হবে। এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। যদি দুই মাস পরপর মূল্যায়ন সভা হতো তবে সেটি থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ আসতো। তিনি বলেন, আরেকটি হলো সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ। আমরা যে মশা নিয়ন্ত্রণ করছি সেটি কীটনাশক নির্ভর। কীটনাশক নির্ভর হলে সবসময় মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না। কচুরিপানার উপর কীটনাশক প্রয়োগ করলে সেটি কাজ করবে না। ডোবাতে প্রচুর ময়লা থাকলে কীটনাশক কাজ করবে না। পরিষ্কার করা প্রথম কাজ তারপর কীটনাশক প্রয়োগ। এর পাশাপাশি মনিটরিং রিপোর্ট নিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। মেডিসিনের মান নিয়ে তিনি বলেন, ফগিং সিস্টেমটা আসলে কোনো কাজে করে না। ধোঁয়ায় এখন আর মশা মরে না। পৃথিবীর কোনো দেশে এখন আর ধোঁয়া দেয়া হয় না। কলকাতাতে হাইকোর্ট আইন করে ফগিং বন্ধ করেছে। তবে লার্ভিসাইড যেটা করা হয় সেটি যদি সঠিকভাবে সঠিক স্থানে সঠিক মাত্রায় করা হয় তাহলে সেটি কার্যকরী। বিভিন্ন ধরনের মাছ ব্যাঙ দিয়ে মশক নিধন সম্পর্কে তিনি বলেন, গাপ্পি মাছ মশক নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী একটি পদক্ষেপ। তবে গাপ্পি মাছটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মশার জন্য গাপ্পি মাছ ছেড়ে পরের দিন আবার কীটনাশক দিয়ে মাছটাকে মেরে ফেললে হবে না।
পাঠকের মতামত
World এ এখন ফগিং করে মশা মারা হয় না। কলকাতা হাইকোর্ট আইন করে ফগিং বন্ধ করেছে। দেশে কামান দিয়ে মশা মারা চলছে। তাজ্জব সব কাজ গুলো। সিটি করপোরেশন এসব নিয়ে কথা বলে না। দুই সিটির মশার পেটে ৮২৭ কোটি টাকা। আয় করার নাম নাই খরচে প্রথম।
৮২৭ টাকা মশা মারতেই শেষ।।
দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই । স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের দুর্নীতির বিচার চাই।
The mosquitos swallowed one crore taka and the corrupt employees swallowed 826 crore taka.