বাংলারজমিন
মানিকগঞ্জে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং
স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ থেকে
১৭ মে ২০২৫, শনিবার
কিশোর গ্যাং। মানিকগঞ্জ শহর জুড়ে আতঙ্কের নাম। এই গ্যাংয়ের উৎপাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের সামনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আড্ডা, ইভটিজিং এমনকি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে মহড়া ও মারামারির ঘটনা ওপেন-সিক্রেট। যা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে অভিভাবক ও সচেতন মহলকে। অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মূলত ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় থেকে জেলা জুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার উৎপত্তির সৃষ্টি হয়। যা এখন ছড়িয়ে গেছে শহর থেকে গ্রামেও। এদের থামাতে পারেনি পুলিশ প্রশাসনও।
সরজমিন জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খান বাহাদুর উচ্চ বিদ্যালয়সহ আশপাশের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের উৎপাত সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কিছু বখাটে শিক্ষার্থীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবাধ্য শিক্ষার্থীরা স্কুল চলাকালীন সময় স্কুলগুলোর সামনে আড্ডা, মহড়া ও স্কুলপড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করে থাকে। কিশোর গ্যাং হিসেবে পরিচিতরা স্কুল ব্যাগের ভেতর দেশীয় অস্ত্র অর্থাৎ চাপাতি, চাইনিজ ও ছোরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় চরকির মতো।
গত মঙ্গলবার শহরে ৩০-৪০ জনের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হাতে চাপাতি চাইনিজসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জেলা শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করার ঘটনা ঘটে। নিজেদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এই তাণ্ডব চালায় উঠতি বয়সের বখাটে। ঘটনায় আহত হয়েছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। আহতদের পক্ষ থেকে মানিকগঞ্জ সদর থানায় মামলাও হয়েছে। শহরের বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ও তালতলা নামক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের উৎপাতে মেয়ে শিক্ষার্থীদের চরম নিরাপত্তাহীনতায় স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়। ফলে অভিভাবকরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব অপরাধী চক্রের বেশির ভাগ সদস্য স্কুলছাত্র। বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তাদের অনেকেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেনি বা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে এমন কিছু তরুণ-যুবকও রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকায়। প্রতিনিয়তই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তারা দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে উৎপাত করে থাকে। হাতে দামি মোবাইল, মেয়েদের ইভটিজিং, প্রকাশ্যে ধূমপান, মারামারিসহ নানান অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত।
তবে অভিযোগ রয়েছে, মানিকগঞ্জ শহরে কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ দায়ী। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কমিটির প্রচলন তৈরি করায় কিশোর গ্যাংয়ের আবির্ভাব হতে থাকে। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ স্কুলপর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটি করে দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে আসছিল। ছাত্রলীগের স্কুল কমিটিকে দিক-নির্দেশনা দিতো জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। একের পর এক রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার ফলে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। মাঝখানে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত কিছুটা কম দেখা দিলেও বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলা জুড়ে তাদের উৎপাত বেড়েছে। এদের থামানো না গেলে সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ পরিস্থিতি নেমে আসবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
তবে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন মানিকগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল খালেক শুভ। মানিকগঞ্জে কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগকেই দায়ী করেন এই নেতা।
আব্দুল খালেক শুভ মানবজমিনকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যেসব বখাটে তরুণরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল তারাই মূলত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ছাত্রলীগ তাদের দিয়ে বিভিন্নভাবে আবারো বিশৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মানিকগঞ্জে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করেছে ছাত্রলীগ। তাদের আক্রমণে এ পর্যন্ত অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
ছাত্রদল সভাপতি আরও বলেন, কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
অথচ তাদের প্রতিরোধে ছাত্রদল ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এমনকি বিগত দিনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ধরে পুলিশেও সোপর্দ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে ছাত্রদল জিরো টলারেন্স।
মানিকগঞ্জ খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, মানিকগঞ্জ শহরে তাদের আপরাধ কোনোভাবেই থামছে না। তাদের থামানো না গেলে আগামী দিনগুলোতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সাবেক এই কলেজ শিক্ষকের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো এদের যাতে কোনো ধরনের প্রশ্রয় না দেয় সে বিষয়ে দলগুলোর নীতি-নির্ধারকদের সচেতন থাকতে হবে। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়াতে হবে এবং অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস মানবজমিনকে বলেন, তারা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে এই মুহূর্তে যদি তাদের থামানো না যায় সামনে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকেও কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছুটির সময় প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকাটা বিশেষ প্রয়োজন।
মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি এসএম আমান উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, কিশোর গ্যাং এবং ইভটিজিং প্রতিরোধে পুলিশ সবসময়ই কাজ করে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজের সামনে এবং আশপাশে আমাদের টহল পুলিশ থাকে। কয়েকদিন আগেও শহরে বিশৃঙ্খলা করলে তাদের কয়েকজনকে থানায় ধরে আনা হয়। পরে অভিভাবকরা মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেন। কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে প্রথমে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ওসি আরও বলেন, গত মঙ্গলবার শহরে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিশৃঙ্খলতার ঘটনায় থানায় দু’টি অভিযোগ জমা পড়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের থানায় ডাকানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অভিভাবক সচেতন না হলে পুলিশের একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কারণ তাদের বয়স কম।