শেষের পাতা
মুরাদনগরে ধর্ষণ
ফজর আলীর বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ
মারুফ কিবরিয়া ও আবুল কালাম আজাদ
১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার
কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের পাঁচকিত্তা বাহেরচর গ্রামে নারী ধর্ষণের ঘটনার জেরে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন গ্রামের বাসিন্দারা। সেই সঙ্গে এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করছেন গ্রামবাসী। তাদের ভাষ্যমতে, ২৬শে জুন রাতে ওই নারীকে নির্যাতনের সঙ্গে সবাই জড়িত ছিল। ফজর আলীর একার দোষ নেই। সঙ্গে তার ভাই শাহ পরানও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
এদিকে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধর্ষণে অভিযুক্ত ফজর আলী এর আগেও গ্রামে একাধিক অপকর্ম করেছেন। বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা আগেও একবার ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া এক এনজিও কর্মকর্তা ঋণের টাকা ফেরত চাওয়ায় ফজর আলী তার জিহ্বা কেটে দেন।
রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আব্দুল করিম মানবজমিনকে বলেন, ফজর আলীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তিনি। ওই ঋণ পরিশোধ না করায় ওই ফিল্ড অফিসার ফজর আলীর কাছে টাকা চান। ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তার জিহ্বা কেটে ফেলেন ফজর। পরবর্তীতে ওই কর্মকর্তা মারাও যান। ওই মামলার আসামি ছিল ফজর। এ ছাড়া বাহেরচর গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ার সাবেক হোসেন চেয়ারম্যান বাড়ির বাতেন মিয়ার বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করে ফজর আলী ও বুমা মানিক। বুমা মানিককে বাহেরচর গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনদিন রাত আটক করে রেখে সমাজপতিরা ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে। তখন ফজর আলী পালিয়ে যায়। আরও বিভিন্ন কারণে বাহেরচর গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে ফজর আলী ওপর।
পাঁচকিত্তা বাহেরচর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফজর আলীর ছোট ভাই শাহ পরানের সঙ্গেও নারীর সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রাম্য সালিশও হয়। এতে শাহ পরান ওই মহিলার বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে শাহ পরানের বড় ভাই ফজর আলীর সঙ্গে ওই নারীর বিচার করতে গিয়ে পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের মধ্যেই দু’জনের কথাবার্তা ও টাকা লেনদেন হয়। একসময় সেটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিষয়টি মানতে পারেননি ছোট ভাই শাহ পরান। ভাইয়ের কীর্তি নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখিও করেন। এতে দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। এ সময় গ্রামের বখাটে আবুল কালাম, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী সুমনের সঙ্গে জোট বাঁধেন শাহ পরান। বৃহস্পতিবার রাতে ফজর ওই নারীর ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহ পরান ও সুমনসহ বেশ কয়েকজন দরজার খিল ভেঙে হামলা শুরু করেন। পাশাপাশি ওই নারীকে বিবস্ত্র করে তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। আর ফজরকে মেরে হাত ও পা ভেঙে দেয়। রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক আলহাজ মহিউদ্দিন অঞ্জন বলেন, ফজর আলী বিএনপি’র কেউ নয়। পরিকল্পিতভাবে বিএনপি’র ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। পরকীয়া হোক বা ধর্ষণ হোক অপরাধ অপরাধই। এটার সঠিক বিচার দাবি করছি।
মুরাদনগর উপজেলা জামায়াতে ইসলামী আমীর আ ন ম ইলিয়াস হোসাইন বলেন, এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক অনৈতিক একটি উচ্ছৃঙ্খল কাজ। অমার্জিত অপরাধ। ধর্ষণের শিকার নারীর ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল করে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। মুরাদনগর উপজেলার বদনাম করেছে তারা সকলেই দূষিত। তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হাকিম সোহেল বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাদের বিচার যেন দৃষ্টান্তমূলক হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি বজায় রেখে সবসময় চলছি। একে অপরের সহায়তা করছি। যারা ভিকটিম হয়েছেন তাদের জন্য খুবই ব্যথিত। খুবই মর্মাহত।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ মুরাদনগর উপজেলা শাখা সভাপতি বাবু দুলাল দেব নাথ বলেন, মুরাদনগরে নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে যথাযথ ও দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে ভুক্তভোগী ও তার পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা প্রদানেরও দাবি জানিয়েছেন।
এই ঘটনায় গত শুক্রবার ফজর আলীকে প্রধান আসামি করে ধর্ষণের মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। মামলার পর পুলিশ ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ঘটনার ভিডিও ধারণ ও অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই ঘটনায় গত রোববার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক একটি মামলাও দায়ের করা হয়, যেখানে চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বলেন, মুরাদনগর থানায় দুইটা মামলা হয়েছে। ৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতি চেয়েছি।
এদিকে থানা সূত্রে জানা গেছে, পাঁচকিত্তা বাহেরচর গ্রামে চার সদস্যবিশিষ্ট পুলিশের একটি টহল টিম রাখা হয়েছে মুরাদনগর থানার পক্ষ থেকে। বিশেষ করে ওই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই টিম কাজ করছে বলে জানা গেছে।