বিশ্বজমিন
শাহের সেই কুখ্যাত কারাগার, যেখানে খামেনিকে অমানসিক নির্যাতন করা হতো
মানবজমিন ডেস্ক
(৯ ঘন্টা আগে) ৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:৪১ অপরাহ্ন

১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে আসীন আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী এক চরিত্র তিনি। দেশে ফতোয়া বা ধর্মীয় আদেশ জারি করার ক্ষমতা রয়েছে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে দেশে ফতোয়া জারি করতে পারেন। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘খোদার শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ভাষণ দিয়েছেন খামেনি। ইসরাইলের হামলা শুরুর পর টানা ১২ দিনের যে যুদ্ধে জড়িয়েছে ইরান তা সমাপ্তির পর এমন ফরমান জারি করেন তিনি।

তবে খামেনির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা হয়ে ওঠার ইতিহাস খুব সহজ ছিল না। তাকে কঠিন বাস্তবতা পার করতে হয়েছে। বন্দি ছিলেন কারাগারের অন্ধকারে। শাহের আমলে তাকে বহু মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। যা তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার আগে শাহ রেজা পাহলভি তাকে যেই কারাগারে আটক করেন সেটি পরবর্তীতে জাদুঘর করা হয়। যার নাম ইবরাত জাদুঘর। এই জাদুঘরই একসময় ছিল রেজার সেই কুখ্যাত কারাগার। এটি তেহরানে অবস্থিত। এই কারাগারের সঙ্গে মিশে আছে এক নৃশংস ইতিহাস। কেননা এখানেই ইসলামি বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদের আটক করে ভয়াবহ নির্যাত চালাতেন শাহের বাহিনী।

আয়াতুল্লাহ খামেনির বন্দি জীবন: ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে বেশ কয়েকবার শাহের হাতে বন্দি হন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। শাহের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সরাসরি ইসলামি বিপ্লবের নেতা হিসেবে বন্দি করা হয় তাকে। বন্দি অবস্থায় খামেনিকে অমানবিক নির্যাত করে শাহের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাভাক। কথিত নাশকতার নামে বিপ্লবীদের কারারুদ্ধ করতেন শাহের বাহিনী। কুখ্যাত সেই কারাগারে ছয়বার অবরুদ্ধ হন ইরানি জনগণের রুহানি এই নেতা। কারাগারটিকে নির্যাতনের নিদর্শন হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন বহু মানুষের সমাগম হয়। কারাগারে অভ্যন্তরের বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, নির্যাতনের জন্য কারাগারে ছোট ছোট খাঁচা রয়েছে। যেখানে বন্দিদের আটক রাখা হতো। আয়াতুল্লাহ খামেনিকেও এসব খাঁচায় রাখা হয়। ওই কারাগারে ছোট ছোট কিছু সেল ছিল। যাতে ছিল মাত্র একটি জানালা। এসব স্থানেও খামেনিকে রাখা হয়েছিল। বর্তমান জাদুঘরটিতে খামেনির একটি মোমের প্রতিকৃতি রয়েছে। যেটির পড়নে রয়েছে কালো পাগড়ি, গোল ফ্রেমের চশমা ও বাদামী রঙের পোশাক। এটি সেই সময়ে খামেনির ওপর নির্যাতন ও সংগ্রামের ইতিহাস।
খামেনির গ্রেপ্তার ও নির্যাত: ১৯৬২ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হন আয়াতুল্লাহ খামেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মদদপুষ্ট সরকার শাহ সরকারের বিরুদ্ধে ইরানের কোম শহর থেকে এই আন্দোলনের সূচনা করেন ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তখন তার প্রধান সহযোগি ছিলেন খামেনি। তার কাজ ছিল খোমেনির বার্তা আয়াতুল্লাহ মিলানি এবং অন্যান্য নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ কাজ করতে গিয়ে ১৯৬৩ সালে বিরজানদ থেকে প্রথমবার আটক হন খামেনি। এরপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে মাশহাদের একাধিক মসজিদে কুরআন এবং ইসলামি দর্শন শাস্ত্রের ওপর শিক্ষকতা করেন তিনি। ক্লাসে ইমাম আলির ওপর লিখিত নাজ আল-বালাগ বিষয়ক লেকচারগুলো হাজার হাজার তরুণ শিক্ষার্থীর মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে। মূলত এসব কর্মকাণ্ডের কারণে তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে সাভাক। ১৯৭৫ সালে মাশহাদে খামেনির বাড়িতে অভিযান চালায় শাহের ওই গুপ্ত বাহিনী। সেসময় তিনি ছষ্ঠ বারের মতো আটক হন। এছাড়া তার সমস্ত বই এবং নোট বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন তেহরানে অবস্থিত সাভাক পরিচালিত ওই কারাগারে বেশ কয়েক মাস আটক থাকেন খামেনি। এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, কারাগারের দিনগুলো ছিল ভয়াবহ। সেখানে বন্দিদের অমানসিকভাবে নির্যাত করা হতো।
খামেনির বিল্পবী চেতনা: ১৯৬০ সাল থেকেই বিপ্লবী আন্দোলনে সক্রিয় হন খামেনি। হয়ে ওঠেন ইমাম খোমেনির একজন বিশ্বস্ত সাগরেদ। শাহ সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর প্যারিসে নির্বাসিত জীবন থেকে ইমাম খোমিনি যখন তেহরানে ফিরে আসেন তখন খামেনি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাকে তখন উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া তেহরানে শুক্রবার জুমার নামাজের ইমামও হন তিনি। যেই দায়িত্ব তিনি এখনও পালন করছেন। ১৯৮৯ সালে তাকে ইসলামি প্রজান্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা (সুপ্রিম লিডার) নির্বাচিত করা হয়।
তেহরান জাদুঘরে খামেনির স্মৃতি: কারাগার থেকে গড়ে তোলা ইবরাত জাদুঘরে খামেনির একাধিক প্রতিকৃতি রয়েছে। যেখানে শাহের শাসনামলে খামেনির বিপ্লবী জীবনের সংগ্রাম এবং নির্যাতনের চিত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘরের কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানি জাতির জন্য খামেনি খোদা কর্তৃক বাছাইকৃত নেতা। জাদুঘরে এসব নিদর্শন সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হলো- শাহের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাভাক কর্তৃক বিল্পবীদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস সংরক্ষণ করা। পাশাপাশি নেতৃত্বের জন্য খামেনির ত্যাগের নিদর্শনও সংরক্ষণ করা হচ্ছে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।

শাহের আমলে হিজাব পড়া ছিল অপরাধ, কারাগারে বন্দি হতেন নারীরা: শুধু আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিই নন তার সঙ্গে হাজার হাজার আলেম, বিপ্লবের নেতৃবৃন্দকে কারাগারে আটক করেছিলেন শাহ। এর মধ্যে ছিল নারীরাও। বিশেষ করে যেসকল নারী হিজাব পড়তেন তাদের বন্দি করতেন শাহের পুলিশ বাহিনী। যদিও আজ ইরানের অনেক নারী হিজাব ছাড়াই চলতে চান। তবে সেই সময় মাথা ঢেকে রাখা ছিল অপরাধ। এই কারণে শাহ রেজা পাহলভি সেই নারীদের বন্দী করতেন। তাদের ছবি আজও জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়।
(এনডিটিভি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত)