খেলা
পাল্লেকেলের ছায়া ‘সিলেট’ পায়নি পূর্ণতা
ইশতিয়াক পারভেজ, (ক্যান্ডি) শ্রীলঙ্কা থেকে
৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার
২০১২, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্যান্ডির নয়নাভিরাম পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামে তখন ম্যাচ চলছিল। হঠাৎই প্রেস বক্সে হাজির হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তিন পরিচালক দেওয়ান শফিউল আরিফিন টুটুল, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ও গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। দেশের সংবাদকর্মীদের খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি তারা অপরূপ সুন্দর এই স্টেডিয়ামটির ছবি তুলছিলেন। কৌতূহলবশত জানতে চাওয়া হয়েছিল, ছবি তোলার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে কিনা। সেই সময় দৈনিক মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিন পরিচালক জানিয়েছিলেন, পাল্লেকেলের অনুকরণে সিলেটে তারা একটি নয়নাভিরাম স্টেডিয়াম তৈরি করতে চান। এখানকার বিখ্যাত ‘গ্রিন গ্যালারি’-র মতো করেই সিলেটেও একটি নির্মাণ করা হবে। এক কথায় জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে প্রথম গ্রিন গ্যালারি স্টেডিয়াম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বিসিবি। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম কেবল দেশেরই নয়, এশিয়ার অন্যতম সুন্দর স্টেডিয়ামের তালিকাতেও নিজের জায়গা করে নেয়। কিন্তু বড় আক্ষেপটা যেন রয়েই গেল পাল্লেকেলের মতো সবুজের ছোঁয়া লাগেনি সিলেটের গ্রিন গ্যালারিতে। একে আক্ষেপ বললেও ভুল হবে না। কেন এমন হলো, তার অবশ্য নানা কারণ, ব্যাখ্যা আছে। এর মধ্যে শুরুতেই নকশার ভুল এবং গ্রিন গ্যালারি নির্মাণে অভিজ্ঞদের সাহায্য না নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। যে কারণে পাল্লেকেলের ছায়া হলেও পূর্ণতা পায়নি সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ১৩ বছর পর গাজী আশরাফ হোসেন লিপু শ্রীলঙ্কা সফরে এসেছেন, তিনি এখন জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক। হয়তো তিনি মাঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে আক্ষেপও করছেন যে ছবি তারা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার মতো হয়নি সিলেটের গ্রিন গ্যালারি! যদিও চোখ বন্ধ করে দুই স্টেডিয়ামের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাবেন। এখানেও মাঠের দুই পাশে কৃত্রিম উপায়ে গ্যালারির মতো করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে দর্শকরা সবুজ ঘাসে বসে খেলা দেখার সুযোগ পান। এটি স্টেডিয়ামটিকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, দুই মাঠের পাশেই আছে সুবিশাল চা বাগান। তবে দুঃখজনকভাবে, সিলেটের গ্রিন গ্যালারি ক্যান্ডির মতো তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। দুই জায়গাতেই বৃষ্টি হয়, তবে সেই বৃষ্টির জল ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থা সিলেট ক্রীড়া সংস্থা করতে পারেনি।
অন্যদিকে গোটা পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামের অন্যতম চালিকা শক্তির বেশির ভাগটাই আসে প্রকৃতি থেকে। ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে এর নির্মাণ শেষ হয়, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির সব ব্যবস্থা রাখা হয়। যেমন, বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে তা পরিশোধন করা হয়, এরপর মেশিন ব্যবহার করে স্টেডিয়ামের পানির অভাব পূরণ করা হয়। কিন্তু সিলেটে নিয়মিত পানির অভাব ও প্রচণ্ড সূর্যের তাপে ঘাস হলুদ হয়ে যায়। শুধুই কি তাই! সিলেটের গ্রিন গ্যালারিটিও ত্রুটিপূর্ণ নকশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি এতটাই খাড়া যে দর্শকরা সেখানে সহজে বসে খেলা দেখতে পারেন না। এই টিলার ঢাল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, এখান থেকে দর্শকদের পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামের ছাদগুলো যেন একেকটি পাওয়ার হাউজ। কারণ পুরোটাতেই সোলার প্যানেল বসানো, যা কিনা এই মাঠের ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে। মূলত, কোনো কিছুর নকল করলে তার চেয়ে ভালো হওয়াটাই জরুরি যেন আসলকেও ছাড়িয়ে যায়!
উভয় স্টেডিয়ামেই গ্রিন গ্যালারি একটি সুন্দর ধারণা ছিল, যা ক্রিকেটকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসে। ক্যান্ডির পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামের গ্রিন গ্যালারি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ব্যবহারিকতার জন্য সফল। অন্যদিকে, সিলেটের গ্রিন গ্যালারি ধারণাটি চমৎকার হলেও, বাস্তবায়নে ত্রুটি এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে এটি তার পূর্ণ সম্ভাবনা পূরণ করতে পারেনি। ক্যান্ডির সবুজ উপত্যকায় অবস্থিত এই স্টেডিয়াম শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের এক অনবদ্য প্রতীক। এই মাঠের গল্প শুধু লঙ্কানদের নয়, এখানে বাংলাদেশ দলেরও কিছু বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কখনো সাফল্যের উচ্ছ্বাস, কখনো বা কঠিন লড়াইয়ের ছাপ পাল্লেকেলের মাটি সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট যাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অংশের। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ওয়ানডে ম্যাচে, ১৮৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ দল ৭ উইকেটে জয় ছিনিয়ে নেয়। এটি ছিল পাল্লেকেলেতে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়, যা দলের আত্মবিশ্বাসকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই জয় শুধু একটি ম্যাচ জেতা ছিল না, তা ছিল বিদেশের মাটিতে নিজেদের প্রমাণ করার আরেকটি ধাপ।