শেষের পাতা
কসবার ‘দ্বিতীয় মন্ত্রী’
জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবারইদ্রিস মিয়া কতোটা ক্ষমতাধর ছিলেন তা জানা আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মানুষের। আর হবেই না কেন- সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের ছোট ভাই বলে কথা। মন্ত্রী সবার কাছে এই পরিচয়েই তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অগাধ ক্ষমতার কারণে ‘দ্বিতীয় মন্ত্রী’ বলেও পরিচয় রয়েছে তার এলাকার মানুষের কাছে। মূল পরিচয় তিনি কসবার পানিয়ারূপে মন্ত্রীর পৈতৃক বাড়ির কেয়ারটেকার। স্থানীয়রা বলেন- ‘বছইরা মুনি’। অর্থাৎ বাৎসরিক বেতনভুক্ত কামলা। তবে এটি প্রকাশ্যে বলার সাহস ছিল না কারও। সরকার পতনের পর বিলের জমি দিয়ে হাঁটু পানি মাড়িয়ে পালিয়েছেন ইদ্রিস। তার ছেলে আলাউদ্দিন বাবু ছিলেন মন্ত্রীর পিএ (পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট)। বাপ-ছেলের চাকরি, বদলি বাণিজ্য, মাদকসহ অন্যান্য মালামালের চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা, একের পর এক পাহাড় কেটে বিনাশ, মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি করাসহ তাদের হাজারো অপকর্ম এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
চাকরির জন্য লাখ লাখ টাকা নেয়ার রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। কতো শত কোটি টাকার মালিক ইদ্রিস আর তার ছেলে সেই হিসাব করছেন এই এলাকার মানুষ।
মন্ত্রী আর পিএ ছেলের বদৌলতে ফকফকা হয়েছে ইদ্রিসের মেয়ের জামাই স্কুলশিক্ষক আমজাদ হোসেন, বাবুর শ্বশুর দলিল লেখক ফরিদ মিয়ার জীবন। কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমজাদ হোসেন পালিয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা দেখিয়ে ২ মাসের ছুটি নিয়েছেন বিদ্যালয় থেকে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসিমা বেগম জানান, ২ মাসের মেডিকেল ছুটিতে আছেন তিনি। কোথায় আছেন জানি না। ২০১৮ সালে এই স্কুলে যোগদানের পর মাঝেমধ্যে স্কুলে আসতেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের কমিটিতে রয়েছেন আমজাদ। টেন্ডারবাজি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, পাহাড় কাটা, খাল ভরাট করা, হামলা-মামলাসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই- যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এই স্কুলশিক্ষক। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও মাস শেষে ভুয়া উপস্থিতি স্বাক্ষর করে তুলে নিয়েছেন সরকারি বেতন-ভাতা। আলোচনা আছে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন আমজাদ। কসবা পৌর এলাকার ইমাম পাড়ায় আমজাদের রয়েছে চার কোটি টাকায় নির্মিত এক সুরম্য অট্টালিকা। ধজনগর ও পানিয়ারূপ বিলে রয়েছে শতাধিক বিঘা জমিজমা। উপজেলার মধুপুর, পাথারিয়াদ্বার, সোনামুড়া, মাণিক্যমুড়াসহ পূর্বাঞ্চলের পরিবেশবান্ধব পাহাড়গুলোকে কেটে শেষ করে দিয়েছেন আমজাদ মাস্টার ও তার ভাই মুক্তার।
অন্যদিকে কয়েক বছর ধরেই কসবা দলিল লেখক সমিতির সভাপতির পদ ফরিদ মিয়ার দখলে। ফরিদ গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ত্রুটিপূর্ণ, রেজিস্ট্রিযোগ্য নয় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এমন দলিল করাই ছিল তার কাজ। ২০১৯ সাল থেকে সরকারের পতন পর্যন্ত দলিল লেখক সমিতির সভাপতি ছিলেন ফরিদ মিয়া। সাব-রেজিস্ট্রার রেহেনা বেগমের কাছে ফরিদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফরিদ সাহেব’ আমাদের সভাপতি। দলিল স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছেন বলেও তার দাবি।
মোট কথা ইদ্রিস-বাবুর আত্মীয়স্বজন হিসেবে থানার দালালি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা জাল বিছিয়ে টাকা কামানো হয়ে উঠেছিল এদের কাজ। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন কসবার মানুষ।
২০১৯ থেকে একবছর কসবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ছিলেন মো. জাকির হোসাইন। আলোচনা আছে ইদ্রিস মিয়ার খামারের গরু দেখতে গিয়ে তিনি তাকে সম্মান করে কথা বলেননি। এই অপরাধে ২০২০ সালে জাকির হোসেনকে মন্ত্রীকে দিয়ে তাৎক্ষণিক বদলি করান ইদ্রিস। বর্তমানে চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় কর্মরত মো. জাকির হোসেন বলেন- ইদ্রিস আমাকে ষড়যন্ত্র করে বদলি করিয়েছে। প্রাণিসম্পদে আমি কসবাকে আলোকিত করেছি। আমি এক টাকা কারও কাছ থেকে ঘুষ নেইনি।
পানিয়ারূপ গ্রামের আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন-ইদ্রিসের ক্ষমতা বলে শেষ করা যাবে না। ওসি-দারোগা তার কাছে কোনো কিছুই ছিল না। তার ডরে মুখ খুলতে সাহস পায়নি কেউ। মন্ত্রী বলছে, আপন ছোট ভাই। ওপেন মিটিংয়ে বলছে।
পানিয়ারূপে মন্ত্রীর বাড়ি থেকে ৫ শ’ গজ দূরে আনোয়ারের বাড়ি। তিনি জানান, মন্ত্রীর পৈতৃক ঘরেই থাকতো ইদ্রিস। মন্ত্রী সফরে এসে কখনো বাড়িতে রাতযাপন করলে ওই রাতে শুধু ইদ্রিস অন্য ঘরে থাকতো। ইদ্রিস আর তার ছেলেদের হাতেই ছিল যেন বাংলাদেশ। বদলি-নিয়োগে বস্তা বস্তা টাকা কামিয়েছে তারা। পানিয়ারূপে ইদ্রিসের এক ভাই আনসার সদস্য মিজান কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়েছেন বলেও জানান মন্ত্রীর এই প্রতিবেশী।
এলাকার আজিম জানান, ইদ্রিস ও বাবু চাকরির জন্য অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। তারা মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছে। মাদকের সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিল এলাকাকে। পাহাড় কেটে শেষ করেছে। তাদের ভয়ে কথা বলতে পারেনি কেউ।
কে এই ইদ্রিস: কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা কাজিয়াতলা গ্রামে বাড়ি ইদ্রিস মিয়ার। তার পিতার নাম আবু ভূঁইয়া। যদিও আদি বাড়ি সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মতিনগর থানার ধনছড়ি গ্রামে। ইদ্রিসের নানার বাড়ি কসবার পানিয়ারূপে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গ্রামে। স্থানীয় খোঁজখবরে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের দিকে চুরি করার দায়ে ইদ্রিসের বিরুদ্ধে গ্রামে সালিশ বসে। এতে তৎকালীন ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্রখ্যাত সালিশকারক আবুল খায়ের মেম্বার ইদ্রিসকে এলাকা ছাড়ার রায় দেন। এরপরই পানিয়ারূপ নানার বাড়িতে আশ্রিত হন ইদ্রিস। তার নানা-মামা ইদ্রিসকে এডভোকেট সিরাজুল হকের (আইনমন্ত্রীর প্রয়াত পিতা) বাড়িতে কাজের ছেলে হিসেবে নিযুক্ত করে দেন। বাড়ির গৃহস্থালি কাজকর্ম করার পাশাপাশি আইনমন্ত্রীর বৃদ্ধা দাদির সেবা করতেন ইদ্রিস। পরে আইনমন্ত্রীর প্রয়াত মা জাহানারা হকের সেবায় নিয়োজিত হন। তিনি তাকে স্বামীর গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে স্থায়ী করে দেন।