শেষের পাতা
মমতাজ ৪ দিনের রিমান্ডে
স্টাফ রিপোর্টার
১৪ মে ২০২৫, বুধবার
জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালে মিরপুর থানায় মো. সাগর হত্যায় দায়ের হওয়া মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। মঙ্গলবার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুয়েল রানা ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন।
এর আগে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম তাকে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষে রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ডের বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, মামলার ঘটনাটি সরজমিন পরিদর্শনপূর্বক গোপনে ও প্রকাশ্যে প্রাথমিক তদন্তে উক্ত আসামির মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই আসামি মামলার এজাহারনামীয় ৪৯ নং আসামি। তিনি মানিকগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই আসামি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে নিপীড়নে ক্যাডার বাহিনীকে উৎসাহিত করতো। মামলার এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাতপরিচয় পলাতক আসামিদের নির্দেশে, প্ররোচনায় এবং মদতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররাসহ মমতাজের ক্যাডাররা বেপরোয়াভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাবেশ/আন্দোলনে আক্রমণ করে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে এবং তাদের ছোড়া গুলিতে মো. সাগর গুলিবিদ্ধ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানা যায়। মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটনসহ অত্র মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত পলাতক আসামিদের অবস্থান নির্ণয় করতে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।
শুনানি ঘিরে আদালতে হট্টগোল: গতকাল রিমান্ড শুনানি ঘিরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা সহ আইনজীবীদের মধ্যে বেশ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।
শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তার বক্তব্যে মমতাজের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং বিতর্কিত মন্তব্যগুলো তুলে ধরেন। এদিকে, রিমান্ড শুনানিতে মমতাজের আইনজীবীকে খুঁজতে বেগ পাওয়া নিয়ে এজলাসে আইনজীবীরা হাসি-তামাশায় মেতে উঠেন।
এদিন দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে মমতাজকে আদালতে আনা হয়। পরে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয় তাকে। বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে তাকে এজলাসে তোলা হয়। এ সময় একসঙ্গে অনেক আইনজীবী সেখানে উপস্থিত হন, এতে আদালতে হট্টগোল তৈরি হয়। আদালতের অনুমতি নিয়ে উপস্থিত আইনজীবীদের শান্ত থাকার অনুরোধ করেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। উপস্থিত আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, শুনানির সময় কেউ পাশ থেকে কথা বলবেন না। এজলাসের ভেতরে কেউ ছবি তুলবেন না। আপনারা এমন কিছু বলবেন না যেন অডিয়েন্সে (উপস্থিত শ্রোতা) বিশৃঙ্খলা হয়।
বেলা ৩টা ৭ মিনিটে শুনানি শুরু হলে মমতাজের হেলমেট ও মাস্ক খোলা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম আদালতকে বলেন, মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
এরপর মহানগর প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, আমরা জাতি হিসেবে আবেগপ্রবণ। একজন ফুটবলার ভালো খেললে আমরা তার খেলাটাই দেখি। তাকে পছন্দ করার কারণ তিনি ভালো খেলেন। তেমনিভাবে নায়িকার অভিনয়, শিল্পীর ভালো গান আমরা পছন্দ করি। তারা কোন দল করে সেটা দেখা হয় না। তাদের কাজটাকে আমরা ভালোবাসি। তবে এই আসামি জনগণের ভালোবাসাটাকে ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব যখন আরেক রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি, গুম, আয়নাঘর, আন্দোলন করলেই যখন গুলি করা হয়, তখন এই মমতাজ গানের ভালোবাসা দিয়ে ফ্যাসিস্টকে সহযোগিতা করে গেলেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের মানুষের ভোট হরণ করলেন।
ফারুকী বলেন, সংসদের অধিবেশনে যেখানে মিনিটে কোটি টাকা খরচ হয় সেখানে তিনি গান গাইলেন, আমার নেত্রী শেখ হাসিনা, সারা বিশ্বে নাই তার তুলনা। সংসদে তোফায়েল, আমুসহ অন্য সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা যেখানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে কটু কথা বলেননি, সেখানে তিনি বক্তব্য রাখলেন খালেদার বাপের নাম কি? এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা ‘শেইম-শেইম’ বলে স্লোগান দেন।
শুনানির সময় জনাকীর্ণ এজলাসের কাঠগড়ায় পুরো সময় গালে হাত দিয়ে বিষণ্ন মনে পিপি’র বক্তব্য শুনতে দেখা যায় মমতাজকে। একপর্যায়ে পিপি আদালতকে বলেন, এই আন্দোলনের সময় যখন হাসিনার মন খারাপ থাকতো তখন তিনি হাসিনাকে গান শোনাতেন। এ সময় এজলাসে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। পিপি’র বক্তব্য শুনে বিষণ্ন মমতাজ নিজেও তখন হেসে দেন। পরবর্তী সময়ে আদালত আসামিপক্ষের বক্তব্য শুনতে চান। সেখানেও আইনজীবীকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় আদালতের। আসামিপক্ষের দাখিল করা নথি দেখে এডভোকেট রেজাউল করিমকে ডাকতে থাকেন আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা। এরপর মমতাজকে বিচারক জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি ওনাকে চেনেন? আপনার আইনজীবী হিসেবে তাকে নিয়োগ করতে চাইলে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেন।
কিছুটা সময় নিয়ে মমতাজ তার আইনজীবীকে শনাক্ত করে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেন। তবে ওই আইনজীবী আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, আজকে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এরপর আদালত বেলা ৩টা ২৮ মিনিটে মমতাজের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন। রিমান্ডের আদেশ শুনে আইনজীবীরা বলে ওঠেন, ৪ দিন না, তাকে ৭ দিনের রিমান্ড দিতে হবে।
এদিকে, রিমান্ড শুনানি শেষে, মমতাজকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। তখন আইনজীবীরা বলেন, তাকে লিফটে নেয়া যাবে না। সিঁড়ি দিয়ে নামাতে হবে। বিএনপি’র অনেক নেতাকে লিফটে নিতে দেয়া হয়নি। হেঁটে হেঁটে তোলা হয়েছে। তাকে ৭ তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে। পরে এজলাসের গেটের সামনে অবস্থান নেন আইনজীবীরা। তারা এ সময় বেশ উচ্চবাচ্য করেন। তখনো আদালতে বিচারকাজ চলছিল।
এসময় পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার ইন্সপেক্টর মো. জাহিদুল ইসলাম আদালতকে বলেন, যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, আসামিকে কিছুক্ষণ কাঠগড়ায় রাখা হোক। তখন বিচারক বলেন, আপনি পারলে লিফটে নামিয়ে নিয়ে যান। জবাবে জাহিদুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য এখানে নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় এখানে তাকে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। তখনো এজলাসে কয়েকজন আইনজীবী অবস্থান করে চিৎকার করছিলেন। পরে আদালত আইনজীবীদের এজলাস ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকীও আইনজীবীদের এজলাস ত্যাগ করতে বলেন। তখন আইনজীবীরা গেটের সামনে অবস্থান নেন। প্রায় ২১ মিনিট এজলাসে রাখা হয় মমতাজকে। পরে নিরাপত্তা বাড়িয়ে তাকে লিফটে তুলে নিচে নামানো হয়। কিন্তু নিচে গিয়েও অবস্থান নেন আইনজীবীরা। পরে নিচ থেকে দ্রুত মমতাজকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় আইনজীবীরা মমতাজকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন ভাষায় কটূক্তি করেন।
এদিকে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ১৯শে জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় জুলাই আন্দোলনে অংশ নেন হকার মো. সাগর। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আসামিরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান ও গুলিবর্ষণ করেন। এ সময় সাগরের বুকে গুলি লাগে। নিহত সাগর পেশায় একজন হকার। সাগরের মা বিউটি আক্তার ওইদিন রাত ৩টায় মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সাগরের লাশের সন্ধান পান। এ ঘটনায় গত বছরের ২৭শে নভেম্বর বিউটি আক্তার বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। এতে শেখ হাসিনাসহ ২৪৩ জনকে আসামি করা হয়, আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ২৫০ থেকে ৪০০ জনকে। এই মামলার ৪৯ নং এজাহারনামীয় আসামি হলেন মমতাজ বেগম। গত ৫ই আগস্টের পর জুলাই আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় করা একাধিক মামলায় আসামির তালিকা নাম রয়েছে মমতাজের। এরই মধ্যে তার ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
উল্লেখ্য, সোমবার রাতে সংগীত শিল্পী ও সাবেক এমপি মমতাজ বেগমকে ধানমণ্ডি থেকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।