দেশ বিদেশ
ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে সেচ সংকটে ৬ কোটি মানুষ
রাজশাহী প্রতিনিধি
১৬ মে ২০২৫, শুক্রবার
ভারতের গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে বাংলাদেশের অন্তত ৬ কোটি মানুষ সরাসরি সেচ সংকটে পড়েছেন। এরমধ্যে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের আরও ৪ কোটি মানুষ নানা মাত্রার পানির ঘাটতির কারণে ক্ষতির সম্মুখীন। ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজশাহীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন নদী গবেষক ও ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ১০০ ভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে এবং ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত পাম্প কার্যকারিতা হারিয়েছে।
পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি বাড়ায় উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি এখন আর খাবার উপযোগী নয়। উজানের পানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমেছে। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় কৃষিতে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৪০ বছরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। নদীর গভীরতা ১৭.৮ শতাংশ এবং পানির প্রবাহ ২৬.২ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারিতে পদ্মায় পানি প্রবাহ ছিল ৯০,৭৩০ কিউসেক, যেখানে ২০২৪ সালের ১লা জানুয়ারিতে তা নেমে আসে ৭৫,৪০৯ কিউসেকে। এক বছরে পানি প্রবাহ কমেছে ১৫,৩২১ কিউসেক। এই সময় গড় বৃষ্টিপাতও কম ছিল ১৯.২ শতাংশ। পানি সংকটের কারণে নদীর তলদেশ ক্রমেই ভরাট হচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে পদ্মার কিছু মাছ ও প্রাণী যেমন- ডলফিন, ঘড়িয়াল এবং ইলিশের আগমন এখন অতীত স্মৃতি। জলজ প্রাণিবৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে বিপন্ন।
ফারাক্কা সমস্যার পটভূমি তুলে ধরে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ১৯৭৭ সালে ভারতের সঙ্গে একটি পাঁচ বছর মেয়াদি পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ ৫৫,০০০ কিউসেক হলে বাংলাদেশ পাবে ৩৪,৫০০ কিউসেক। যদি পানির পরিমাণ কমে যায়, তাহলে বাংলাদেশ পাবে কমপক্ষে ২৭,৬০০ কিউসেক, যা ছিল গ্যারান্টি ক্লোজ। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেই চুক্তি নবায়নের পরিবর্তে স্বাক্ষর হয় একটি সমঝোতা স্মারক। এতে গ্যারান্টি ক্লোজ বাদ দেয়া হয়, ফলে বাংলাদেশের অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সমস্যার সমাধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রকৃত পানি পাচ্ছে কিনা তা জনগণকে অবহিত করা, ২০২৬ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে চুক্তির পূর্ণ পর্যালোচনা, নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের গ্যারান্টি ক্লোজ সংযুক্ত করা, যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করা ও নিয়মিত বৈঠক, ভারত কর্তৃক আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রভাব বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন, আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠন (জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে), ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি, ক্ষতিপূরণ দাবি নিরূপণে বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা।
ফারাক্কা সমস্যাকে শুধু পানি সংকট নয়, বরং একটি আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও ভূরাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখার আহ্বান জানান মাহবুব সিদ্দিকী। তার মতে, ‘এই সংকট মোকাবিলায় মজবুত জাতীয় ঐক্য, সক্রিয় কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিকল্প নেই।’
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ‘ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন কমিটি’। সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন ফারাক্কা লংমার্চে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাহমুদ জামাল কাদেরীসহ সংশ্লিষ্টরা।