দেশ বিদেশ
যে কারণে এইচএসসি’র পাসের হার কমেছে গড় পাস ৭৭.৭৮
স্টাফ রিপোর্টার
১৬ অক্টোবর ২০২৪, বুধবারএইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কমে এসেছে গড় পাসের হার। চলতি বছরের ফলে দেখা যায় পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ। কোটার সংস্কার আন্দোলন বিকট আকার ধারণের আগেই হয় সাতটি বিষয়ের (সিলেট শিক্ষা বোর্ড ছাড়া) পরীক্ষা। কয়েক দফা স্থগিতের পর একাংশ পরীক্ষার্থীদের দাবির মুখে বাতিল হয় বাকি পরীক্ষাগুলো। পরীক্ষা না হওয়া বিষয়ে শিক্ষার্থী নম্বর পান সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে। যেহেতু বিষয় কমে এসেছে অনেকের ধারণা ছিল গড় পাসের হার গড়তে যাচ্ছে নয়া রেকর্ড। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে ০.৮৬ শতাংশ। পাসের হার কমলেও বেড়েছে সর্বোচ্চ ফল জিপিএ-৫’ধারীর সংখ্যা। গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫৩ হাজার। বরাবরের মতোই এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা।
গতকাল ভিন্ন পরিবেশে প্রকাশিত হয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল। অন্যবার প্রধানমন্ত্রী ফলাফল উদ্বোধন করতেন। এরপর সেই ফলের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ফল পেতেন শিক্ষার্থীরা। এবার কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে, ওয়েবসাইটে ও এসএমএস’র মাধ্যমে ফল পান তারা। গত বছর পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এবার পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ, পাসের হার কমেছে ০.৮৬ শতাংশ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৯.২১ শতাংশ, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ৭০.৩২ শতাংশ, বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে ৮১.৮৫ শতাংশ, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ৮১.২৪ শতাংশ, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে ৭১.১৫ শতাংশ, যশোর শিক্ষা বোর্ডে ৬৪.২৯ শতাংশ, সিলেট শিক্ষা বোর্ডে ৮৫.৩৯ শতাংশ, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে ৭৭.৫৬ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৩.২২ শতাংশ। এ ছাড়াও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিমে পাসের হার ৯৩.৪০ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৮৮.০৯ শতাংশ।
এবার মোট এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৪৮ হাজার ৫৪৮ জন, রাজশাহীতে ২৪ হাজার ৯০২, কুমিল্লায় সাত হাজার ৯২২, যশোরে ৯ হাজার ৭৪৯, চট্টগ্রামে ১০ হাজার ২৬৯ জন, বরিশালে ৪ হাজার ১৬৭, সিলেটে ৬ হাজার ৬৯৮, দিনাজপুরে ১৪ হাজার ২৯৫, ময়মনসিংহে চার হাজার ৮২৬, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৯ হাজার ৬১৩ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৪ হাজার ৯২২ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত ১৫ বছরের ন্যায় এবারো ফলে এগিয়ে ছাত্রীরা। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের ২ হাজার ৬৯৫টি কেন্দ্রে পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। এরমধ্যে ছাত্র ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩ জন ও ছাত্রী ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫ জন। ছাত্রীদের পাসের হার ৭৯ দমশিক ৯৫ শতাংশ। আর ছাত্রদের পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮০ হাজার ৯৩৩ জন আর ছাত্র ৬৪ হাজার ৯৭৮ জন। এদিকে ফল পছন্দ না হওয়া শিক্ষার্থীরা আজ থেকে ২২শে অক্টোবর পর্যন্ত এসএমএস’র মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০শে জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা বাকি ছিল। হয়নি ব্যবহারিক পরীক্ষাও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাকি পরীক্ষা পিছিয়ে ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে নতুন সময়সূচিতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু ২০শে আগস্ট একাংশ পরীক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে এইচএসসি বা সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়। পরীক্ষা না হওয়া বিষয়গুলোর ফল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে হয়। যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি সেগুলোতে একজন পরীক্ষার্থী এসএসসিতে একটি বিষয়ে যত নম্বর পেয়েছিলেন, এইচএসসিতে সেই বিষয় থাকলে তাতে এসএসসিতে প্রাপ্ত পুরো নম্বর বিবেচনায় নেয়া হয়। আর এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বিষয় ম্যাপিংয়ের নীতিমালা অনুযায়ী নম্বর বিবেচনা করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এসএসসিতে যে পরীক্ষার্থী বিজ্ঞানে পড়েছিলেন, এইচএসসিতে হয়তো তিনি ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক শাখায় পড়েছেন। সে ক্ষেত্রে এসএসসিতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর প্রাপ্ত নম্বর পরীক্ষার্থীর এইচএসসির ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের নৈর্বাচনিক বিষয়ের নম্বর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ফলের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঢের এগিয়ে রয়েছে সিলেট শিক্ষা বোর্ড। বন্যার কারণে সিলেট বোর্ডে পরীক্ষা শুরু হয় দেরিতে। বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ৯ই জুলাই থেকে আইসিটির মাধ্যমে সিলেট বোর্ডে পরীক্ষা শুরু হয়। পরে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় সিলেটের পরীক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে আর পরীক্ষা দিতে হয়নি। ইংরেজি পরীক্ষা না হওয়ায় এই বোর্ডে পাসের হার ৮৫.৩৯ শতাংশ। যা সাধারণ বোর্ডগুলোর তুলনায় সর্বোচ্চ। ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার সব থেকে কম ৬৩.২২ শতাংশ। এই বোর্ডের ইংরেজিতে পাসের হার ৭৭ দশমিক ১১ শতাংশ, আইসিটিতে ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। আবার পদার্থবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ফেলের হার ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ ও ২৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। যশোর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় ফল বিপর্যয় ইংরেজির কারণে। যশোর বোর্ডে শুধু ইংরেজিতে ফেল ৩১ দশমিক ২৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩১ শতাংশ ও কুমিল্লায় ২০ দশমিক ০৭ শতাংশ।
এবার ৯ হাজার ১৯৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৫টির কোনো পরীক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। আর সব শিক্ষার্থী পাস করেছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৩৮৮টি। গত বছর শূন্য পাস ছিল ৪২টি প্রতিষ্ঠানে। শতভাগ অনুত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ২৩টি। পরীক্ষায় অংশ নেয়া সব শিক্ষার্থীই পাস করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল ৯৫৩টি। তার মানে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩৫টি। শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করা দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে ২০টি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৮টি, রাজশাহীতে ২টি, কুমিল্লায় ৪টি, যশোরে ৭টি, চট্টগ্রামে ৫টি এবং ময়মনসিংহের ৪টি, মাদ্রাসা বোর্ডে ২টি ও কারিগরিতে ৩টি। শতভাগ পাস করা ১৩৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৬১টি প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে। এ ছাড়া কারিগরি বোর্ডের ২৫০টি প্রতিষ্ঠান থেকে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। ঢাকা বোর্ডে ৫৭টি, রাজশাহীতে ৩৫টি, কুমিল্লায় ১০টি, যশোরে ও চট্টগ্রামে ১৩টি করে ২৬টি, বরিশালে ২১টি, সিলেটে ৮টি, দিনাজপুরে ১৫টি এবং ময়মনসিংহে ৫টি। মাদ্রাসা বোর্ডে গত বছর শতভাগ পাস করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৬১টি আর কারিগরি ১৪০টি। দেশের বাইরে ৮টি কেন্দ্রে বসেছিলেন ২৮২ জন, পাস করেছেন ২৬৯ জন। পাসের হার ৯৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীর সবাই পাস করেছেন।
এ বছরে শিক্ষার্থীরা দেশের অস্থিরতম সময়ে দিয়েছেন পরীক্ষা। যার কারণে স্বভাবতই মনস্তাত্ত্বিক কারণে পিছিয়ে ছিলেন তারা। অনেকেই পরীক্ষার পাশাপাশি আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। যার কারণে সে প্রভাবও পড়েছে পরীক্ষায়। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশ না করা হলেও আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার ফলের বিষয় গণমাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি এ সময় বলেন, পাসের বিষয়টি মূলত নির্ভর করে আবশ্যিক বিষয়ের ফলের ওপর। যেহেতু আবশ্যিক বিষয়ের পরীক্ষাগুলো হয়ে গিয়েছিল তাই পাসের হার সাধারণ সময়ের মতোই হয়েছে। সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কিছুটা প্রভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকবেই। তবে সেটা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হবে না। কারণ যেখানেই তারা ভর্তি হতে যাক না কেন তাদের এডমিশন টেস্টের মধ্যদিয়ে তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। আর এ বিষয়ে লেখাপড়ারও প্রস্তুতি থাকে। ইন্টারন্যাশনালি এই সাবজেক্ট ম্যাপিং বিষয়টি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাতিল হওয়া বিষয়গুলোর পরীক্ষা দেয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ছিল। অভিভাবক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে অনুরোধ রইলো ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। পরীক্ষাগুলো দেয়া উচিত। পরীক্ষার মাধ্যমেই ফলাফল আসে। আমরা কতোটুকু শিখলাম তার জাস্টিফিকেশন পরীক্ষার মাধ্যমেই হয়। পরীক্ষা নেয়া আমাদের কর্তব্য। আশা করবো আগামীতে পরীক্ষাগুলো যাতে হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবো।