শেষের পাতা
এসেসমেন্ট শাখার দুর্নীতিতে অসহায় সিলেট নগরবাসী
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১৪ জুন ২০২৫, শনিবার
সিলেট নগরের মানুষের কাছে আতঙ্ক সিটি’র কর। বাসা-বাড়ির হোল্ডিং, পানিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে কর দিতে হয়। তবে সব করের মধ্যে যে করের বোঝা নিয়ে নগরবাসী চিন্তিত সেটি হচ্ছে বাসা-বাড়ির হোল্ডিং কর। এটি তদারকি করে সিটি করপোরেশনের এসেসমেন্ট শাখা। এই শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। করের হিসেবেও হচ্ছে নয়ছয়। অভিযোগ রয়েছে; এতে দু’হাতে টাকা লুটেন এই শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। মাঠ পর্যায় থেকে অফিস সবখানেই দিতে হয় ঘুষ। এই শাখার প্রধান মো. আব্দুল বাছিত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এসেসমেন্ট শাখায় কাজ করছেন। বর্তমান দায়িত্ব প্রধান এসেসর। ২০২৩ সালে তখন সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা তিনি। তার আমলেই সিলেট সিটি’র নতুন গৃহকর ধার্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এতে করে হৈচৈ শুরু হয় নগর জুড়ে। আনোয়ারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এসেছিল আন্দোলনের ডাকও। তখন নগরে খবর রটেছিল নতুন কর ধার্য হলে কর বাড়বে বহুগুণ। এই খবরে নগর ভবনে পুরাতন নিয়মে কর দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন আতঙ্কে থাকা নগরবাসী। ওই সময় নগর ভবনের হর্তাকর্তা ছিলেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত শহীদ চৌধুরী। তিনি মেয়রের পিএস ছিলেন। তার সঙ্গেই দুর্নীতির টিমওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন আব্দুল বাছিত। করে ফাইল নিজেই ছাড় দিতেন শহীদ। টাকা নিতেন বাছিত।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মতে; সিলেট নগর ভবনের এক এসেসমেন্ট শাখায়ই তখন কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি নজরে আসে আনোয়ারুজ্জামানের। গণ-অভ্যুত্থানের কয়েকদিন আগে শহীদকে নগর ভবন থেকে বিদায় করে দেন। তবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন আব্দুল বাছিত। সঙ্গে তার দুর্নীতির নেটওয়ার্কও। চারজনের এই চক্রে এসেসমেন্ট শাখায় দুর্নীতি হচ্ছে সরবে। বর্তমানে সিলেট সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত রয়েছে। জনপ্রতিনিধি না থাকার কারণে কার্যক্রমে গতি আসছে না। কিন্তু এসেসমেন্ট শাখা বসে নেই। যেখানে নতুন ভবন হচ্ছে সেখানেই তারা ঢুঁ মারছে। পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডসহ নতুন ১৫ ওয়ার্ডে তারা নানা কর্মকাণ্ড করছে। এতে দেখা গেছে; বাসা বাড়িতে যাচ্ছে মাঠ পর্যায়ের টিম। এসেসমেন্ট করে অফিসের বসের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলা হচ্ছে। টাকা দিলে নামমাত্র কর দিয়েই কাজ হয়। আবার টাকা না দিলে ভোগান্তির অন্ত থাকে না। কয়েকজন গ্রাহক জানিয়েছেন- এসেসমেন্ট শাখায় বন্দি হয়ে গেছেন নগরের মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে চারজনের একটি গ্রুপ এসেসমেন্ট শাখায় কাজ করছে। তারাই সিন্ডিকেট করে লুটে নিচ্ছে টাকা। আব্দুল বাছিত প্রথমে সিলেট পৌরসভায় টাইপিস্ট হিসেবে নিয়োগ পেলেও পরবর্তীতে তিনি কামরানের জমানায় ২০০০ সালের দিকে সহকারী এসেসর হিসেবে বদলি হন। তার বর্তমান পদ এসেসর হলেও কয়েক মাস আগে তিনি প্রধান এসেসরের দায়িত্ব পেয়েছেন। নগরের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও প্রধান এসেসর আব্দুল বাছিতের সম্পদ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। খাসদবির এলাকায় রয়েছে তার বিলাসবহুল বাড়ি। যদিও এটি তার প্রবাসী স্বজনদের অর্থায়নে এ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন তিনি। তবে সিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন- মেয়র কামরানের সময় বেপরোয়া ছিলেন সহকারী এসেসর আব্দুল বাছিত। এরপর মেয়র আরিফের সময়ও তিনি দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন। আর আনোয়ারুজ্জামানের সময় তার সঙ্গী ছিল আলোচিত শহীদ চৌধুরী।
সম্প্রতি সময়ে তিনিও দাপট দেখাচ্ছেন সিটিতে। তার আরেক সহযোগী এসেসর কবির উদ্দিন চৌধুরী পানি শাখায় নিয়োগ পেলেও দীর্ঘদিন থেকে এসেসমেন্ট শাখায় কাজ করছেন। আব্দুল বাছিতের প্রধান সহযোগী হিসেবে তিনি ওই শাখায় কাজ করছেন। বাছিত ও কবিরের আরও দু’সহযোগী বাবলু ও মাহবুব মাস্টাররোলে বদর উদ্দিন কামরানের সময় নিয়োগ পায়। ২০১২ সালের দিকে হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের চাকরি স্থায়ী হয়। এরপর থেকে তারাই বেপরোয়া দুর্নীতির সহযোগী হয়ে ওঠেন। তাদের প্রভাব এত বেশি যে কেউ সাহস করে অভিযোগ করার সাহস পায় না। নগরের সবুজবাগ এলাকার ভুক্তভোগী আব্দুর রহিম জানিয়েছেন- ‘আমার একটি করের সমস্যা নিয়ে বাছিত ও কবিরের কাছে বারবার দ্বারস্থ হলেও তাদের অবৈধ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কোনো প্রতিকার পাইনি। বাগবাড়ী এলাকার আব্দুল মতিন জানান- শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আমার একটি বহুতল ভবনের জন্য বাছিত ও তার এক সহকারী যে তার নিকট আত্মীয় আমার কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করে। আমি ব্যাংক ঋণে জর্জরিত বলার পরও পুনরায় বাণিজ্যিক দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের হোল্ডিং টেক্স আমার ওপর ধার্য্য করে।
উপশহর এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক করদাতা জানান- মুজাক্কির নামে বাছিতের এক ভাগিনা এই ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছে। তার কাজ হলো ওই এলাকায় বিল্ডিং খুঁজে বের করা। সেখানে প্রাথমিকভাবে বিশাল করের চিঠি ভবন মালিকদের ধরিয়ে দেয়। এরপর বাছিত ও কবিরের সামনে করদাতাকে নিয়ে যায়। যারা তাদের প্রস্তাবে রাজি হয় তাদেরকে সর্বনিম্ন হারে কর ধার্য্য করে দেয় আর যারা এসব প্রস্তাবে রাজি হয় না তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করে। এ ব্যাপারে বক্তব্য নিতে প্রধান এসেসর আব্দুল বাছিতের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। তবে এসেসমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- এখন নতুন এসেসমেন্ট, কর ধার্য, আদায় সব বন্ধ রয়েছে। সিদ্বান্ত নিয়ে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করা হবে। এসেসমেন্ট শাখার দুর্নীতির বিষয়ে তারা বলেন- তদন্তপূর্বক অভিযোগ সত্য হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মানুষের ভোগান্তি হয় এমন কোনো কাজ সিলেট সিটি করপোরেশন থেকে করা হবে না বলে জানান তারা।
পাঠকের মতামত
একদম সত্যি কথা। অসম্ভব রকম দুর্নীতি। সবাই ভুক্তভোগী।
এই চুরগুলো এখন ও বহাল তবিয়তে থাকে কেমন করে?