মত-মতান্তর
জনগণ ও তাদের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মূলকথা
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
(১ মাস আগে) ২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১১:০৮ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:১০ অপরাহ্ন
বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সাথে অসমঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। তার মানে জনগণ হচ্ছে সবকিছু এবং তাদের অভিব্যক্তিই সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূল কথা।
সংসদ আইন প্রণয়ন করবে যে আইন প্রত্যেক নাগরিককে মেনে চলতে হবে। এই সংসদ থেকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবে, গঠিত হবে মন্ত্রিসভা। এই সংসদই সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। প্রয়োজনে অনাস্থা প্রস্তাব এনে ও পাস করে সরকারের আয়ু শেষ করে দিতে পারে সংসদ। এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে। এই সংসদ বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংবিধান পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করতে পারে। আমাদের সংসদ হলো ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্ট মডেলের। বৃটিশ পার্লামেন্টের অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে বলা হয় “British Parliament can make or unmake anything except man into woman (বৃটিশ পার্লামেন্ট পুরুষকে নারীতে পরিণত করা ছাড়া অন্য কিছু করতে বা পূর্বাবস্থায় আনতে পারে)। অর্থাৎ আমাদের সংসদ বৃটিশ পার্লামেন্টের মতো সার্বভৌম, অসীম ক্ষমতার মালিক। আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই খোদ সার্বভৌম সংসদের সদস্যরা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হোন জনগণ দ্বারা। তাহলে বুঝা গেল জনগণের সঠিক ম্যান্ডেটই সব কর্মকাণ্ডের মূল, ভিত্তি ও চালিকা শক্তি।
এখন জনগণের ম্যান্ডেট নেয়া যদি ত্রুটিযুক্ত ও গলদপূর্ণ হয় তাহলে সেই ম্যান্ডেটের আওতায় বা ম্যান্ডেটের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত সব কর্মকাণ্ড প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, প্রশ্ন আসে বৈধতার (legitimacy’র)। বাংলাদেশের সংবিধানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবে ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্নতা ও সাংঘর্ষিক অবস্থাই একাধিক বার সৃষ্টি করেছে জাতীয় জীবনে জটিলতা ও চরম বিশৃঙ্খলা। জনগণের সঠিক ম্যান্ডেট নেয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচন ও ভোট। আর সেই নির্বাচন ও ভোটকে বিগত সরকার বানিয়েছি তামাশা ও হাসির পাত্র। আফসোস।
চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন ও অন্যের অধিকার হরণ যদি ফৌজদারি অপরাধ হয়, তাহলে ১৮ কোটি মানুষের অভিব্যক্তি ও ম্যান্ডেটকে নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে ও তাদের অধিকার হরণ করেছে তা যে কত বড় ফৌজদারি অপরাধ করেছেন তা সহজেই বোধগম্য। অথচ এই কাজটি করেছে পতিত সরকার পরপর তিন তিনটি সংসদীয় টার্মে।
সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সাংবিধানিক নির্দেশ। ১১ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে”।
অপরদিকে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ বলেছে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হবে। ৬৫(২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন”।
এবার সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ ও ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত যথাক্রমে “জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ” এবং “প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে” শব্দগুলোর সাথে হাল বিগত তিনটি নির্বাচনের তুলনা করুন আর মনকে প্রশ্ন করুন কোথায় সংবিধান ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা আর কোথায় বাস্তবতা! যেখানে সংবিধান মতে নির্বাচনে “জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ” এবং সংসদ গঠিত হওয়ার কথা ছিল“প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে”, সেখানে বিগত তিন তিনটি নির্বাচন হয়েছিল যথাক্রমে বিনা ভোটের নির্বাচন (২০১৪ সালের নির্বাচন), নিশি রাতের/আগের রাতের নির্বাচন (২০১৮ সালের নির্বাচন ) ও ডামি নির্বাচন (২০২৪ সালের নির্বাচন)।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি ছাড়া অন্যটি চিন্তা করা যায় না। এ ব্যাপারে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে [An Indian Case (2002) 8 SCC 237] বলেছে “Free, fair elections are part of the basic structure of the constitution. Democracy and free fair elections are in separable twin. There is almost an inseparable umbilical cord joining them. The little man's ballot and not the bullet is the heart beat of democacy” (অর্থাৎ “অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। গণতন্ত্র এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অবিচ্ছিন্ন যমজ। তাদের সাথে প্রায় অবিচ্ছেদ্য নাভির সংযোগ রয়েছে। ছোট মানুষের ব্যালটই, বুলেট নয়, গণতন্ত্রের হৃদস্পন্দন)।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র। একটি স্বাধীন দেশ ও জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বহু আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ও চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি দলিল হলো: The Universal Declaration of Human Rights (UDHR) and the International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR). UDHR- এর ২১(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে “The will of the people shall be the basis of the authority of government; this will shall be expressed in periodic and genuine elections which shall be by universal and equal suffrage and shall be held by secret vote or by equivalent free voting procedures (অর্থাৎ “জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি; এই ইচ্ছাটি পর্যায়ক্রমিক এবং প্রকৃত নির্বাচনে প্রকাশ করা হবে যা সার্বজনীন এবং সমান ভোটাধিকার দ্বারা হবে এবং গোপন ভোট বা সমতুল্য অবাধ ভোটদান পদ্ধতি দ্বারা অনুষ্ঠিত হবে”)।
অপরদিকে ICCPR -এর ২৫(বি) অনুচ্ছেদে আছে “Every citizen shall have the right and the opportunity to vote and to be elected at genuine periodic elections which shall be by universal and equal suffrage and shall be held by secret ballot, guaranteeing the free expression of the will of the electors” (অর্থাৎ “প্রতিটি নাগরিকের ভোট দেয়ার এবং প্রকৃত পর্যায়ক্রমিক নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার এবং সুযোগ থাকবে যা সার্বজনীন এবং সমান ভোটাধিকারের দ্বারা হবে এবং গোপন ব্যালটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচকদের ইচ্ছার অবাধ অভিব্যক্তির নিশ্চয়তা প্রদান করবে”)।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর হতে চললো এখনও আমরা রাষ্ট্রের মালিক জনগণের অভিব্যক্তি ও ম্যান্ডেট নেয়ার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির সঠিক ও যথাযথ বন্দোবস্ত করতে পারিনি। এজন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে বারবার, জীবন দিতে হয়েছে অসংখ্য। এই সংগ্রাম ও জীবন দানের ধারাবাহিকতায় শেষ পরিণতি হলো ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। আর কত সংগ্রাম করতে হবে? আর কত জীবন দিতে হবে? আসুন, আমরা রাষ্ট্রের মালিক জনগণের অভিব্যক্তি ও মেন্ডেট নেয়ার এমন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি চালু করি যেন এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। কেউ যেন রাষ্ট্রের মালিকদের অভিব্যক্তি ও ম্যান্ডেট নিয়ে আর কখনও ছিনিমিনি খেলতে না পারে।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
email: [email protected]