ঢাকা, ১৭ মে ২০২৫, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

বিশ্বজমিন

বিমানে আরোহণ করেও যিনি যাত্রী নন

মানবজমিন ডেস্ক

(৩ ঘন্টা আগে) ১৭ মে ২০২৫, শনিবার, ৫:৪৯ অপরাহ্ন

mzamin

বৃটিশ এয়ারওয়েজের একজন যাত্রী ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক ক্যাথরিন স্নোডন। তিনি ডকুমেন্টারি বানাতে মাদ্রিদ যাচ্ছিলেন। কিন্তু বোর্ডিং পাসে তার নামের পরিবর্তে লেখা হয় হিউ এইচ। ফলে মারাত্মক এক ঝুঁকির মুখে পড়েন তিনি। সেই কাহিনী অনলাইন বিবিসিতে বিস্তারিত লিখেছেন তিনি। নিচে তার মুখেই সেই কাহিনী পড়ুন-  

মাদ্রিদের একটি সাম্প্রতিক ফ্লাইটে আমার সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছিল: অজান্তেই ভুল পরিচয়ে ভ্রমণ করেছি আমি। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি বড় সমস্যা ছিল। অথচ কেউ কিছু বুঝতেই পারেনি। আমি বিবিসির জন্য একটি ডকুমেন্টারি তৈরির উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত সফরের জন্য প্যাকিং করছিলাম, যখন আমি অনলাইনে চেক-ইন করার চেষ্টা করি। তা ব্যর্থ হওয়ায় আমি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে সরাসরি গিয়ে চেক-ইন করার সিদ্ধান্ত নিই। বিমানবন্দরে পৌঁছে আমি আবার একটি সেলফ-সার্ভিস বুথে চেক-ইনের চেষ্টা করি। কিন্তু আবারও ব্যর্থ হই। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি ত্রুটিপূর্ণ কোড: ‘সহায়তা প্রয়োজন’। শেষ পর্যন্ত আমি একটি চেক-ইন ডেস্কে যাই এবং লাগেজ জমা দেওয়ার পর বৃটিশ এয়ারওয়েজের একজন কর্মী আমাকে একটি বোর্ডিং পাস দেন। আমি অবশ্য বোর্ডিং পাসটি ভালো করে পড়িনি, বরং স্বাভাবিকভাবে নিরাপত্তা চেকিং এলাকায় চলে যাই। গেটের কাছে, ২৩ এপ্রিল সকাল ১০:৫০-এ ছাড়ার কথা ছিল বিএ৭০৫৫ ফ্লাইটের। এটি পরিচালনা করছিল বৃটিশ এয়ারওয়েজের স্প্যানিশ পার্টনার আইবেরিয়া। আমি যেহেতু ছয় নম্বর সারিতে ছিলাম, তাই সবার আগেই বোর্ড করি। আমার পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাস হ্যান্ডওভারের সময় বিএ গ্রাউন্ড স্টাফ কেবল একবার চোখ বুলিয়ে আমাকে ঢুকতে দেয়। বিমানে উঠে দেখি আমার আসন বিজনেস ক্লাসে। ভেবেছিলাম এটি বোধহয় ফ্রি আপগ্রেড, কারণ সাধারণত আমি ইকোনমি ক্লাসেই যেতাম। এই ফ্লাইটটি আমরা বেছে নিয়েছিলাম কারণ এটি আমাদের চিত্রগ্রহণ সরঞ্জামের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী ছিল।

বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের জন্য পরিবেশন করা হয় সুস্বাদু বেকড কড ও ছোলার স্ট্যু। সঙ্গে টিরামিসু ডেজার্ট। অবশ্য অফিসিয়াল সফর হওয়ায় কোনো অ্যালকোহল নিইনি। কিন্তু স্পেনের রাজধানীতে পৌঁছানোর পর শুরু হয় সমস্যা। অবতরণের পর মোবাইল নেটওয়ার্ক পেলেই আমি একটি ইমেইল পাই: আমার ফেরার ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়েছে।
বিবিসির ট্রাভেল প্রোভাইডারের কাছে জানতে চাইলাম কী হয়েছে এবং এখন আমাকে দেশে ফেরানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? উত্তরে ট্রাভেল কোম্পানি জানায়, যেহেতু আমি আউটবাউন্ড ফ্লাইটে উপস্থিত হইনি, তাই রিটার্ন ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আমি তাদের বুঝিয়ে বলি যে, আমি বাস্তবেই মাদ্রিদে আছি এবং লাগেজ বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে আমার ব্যাগের জন্য অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছিল এর শেষ হবেই না।

আমাদের ট্রাভেল টিম এবং বৃটিশ এয়ারওয়েজের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথোপকথনের পর তারা জানায় যে, এয়ারলাইন জোর দিয়ে বলছে আমি আদৌ ভ্রমণ করিনি এবং আমার কাছে থাকা বোর্ডিং পাসে সঠিক নাম ছিল না। এই সময় আমি আবিষ্কার করি, আমার বোর্ডিং পাসে লেখা নাম আমার নয়, বরং হিউ এইচ নামের এক ব্যক্তির। বিবিসি তার পুরো নাম প্রকাশ করছে না, তবে সেটি বোর্ডিং পাসে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল। এই একই নাম ছিল আমার লাগেজ ট্যাগেও।

বৃটিশ এয়ারওয়েজ দাবি করেছে, এমন একটি ডকুমেন্ট ব্যবহার করে আমার ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। কারণ নিরাপত্তা চেকিং তা অনুমোদন করে না। কিন্তু আমি সত্যিই গিয়েছিলাম। আমার সহকর্মী, যিনি কয়েক সারি পেছনে বসেছিলেন, তিনিও আমাকে বিমানে দেখেছেন। এয়ারলাইন এতটাই নিশ্চিত ছিল যে-  আমি মাদ্রিদে নেই, বিবিসিকে আমার ফেরার আসল ফ্লাইটে একটি নতুন টিকিট কিনতে হয়- যা ছিল ব্যয়বহুল। বৃটিশ এয়ারওয়েজ পরে ৫০০ পাউন্ডের একটি ‘গুডউইল ভাউচার’ ও অতিরিক্ত টিকিটের অর্থ ফেরত দিয়েছে। বিমানে বোর্ডিংয়ের জন্য নিরাপত্তা প্রক্রিয়া সাধারণত খুবই সোজা: বোর্ডিং পাসের নামটি পাসপোর্টের নামের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। এই ক্ষেত্রে, বোর্ডিং গেট বা চেক-ইনে কেউই সেই নামের অমিল বুঝতে পারেনি।

একটি ‘অসাধারণ’ ঘটনা
ইন্টারনেট ঘেঁটে হিউ এইচ সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্যই বের করতে পেরেছি। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তার নাম ব্যবহার করে কিছু অ্যাকাউন্টে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। এতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে-  এই নামে আদৌ বাস্তবে কেউ আছে তো? একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তার নাম জোনাথন হিউ এইচ। তিনি ২৪ এপ্রিল একটি বিএ ফ্লাইটে হিথ্রোতে অবতরণ করেছেন আমার ফ্লাইটের একদিন পরে। তাহলে কি তার নাম কোনোভাবে বিএ সিস্টেমে ঘুরপাক খাচ্ছিল? জোনাথন বললেন, এটা সত্যিই দুশ্চিন্তার বিষয়। আমার বিয়ের পরের নাম, যা আমার বুকিং কনফার্মেশন এবং পাসপোর্টে ছিল। সেটিও এইচ অক্ষর দিয়ে শুরু, যদিও সেটি হিউ এইচ-এর নামের সঙ্গে মিলে না। এটা কি কোনোভাবে প্রভাব ফেলেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, আর বৃটিশ এয়ারওয়েজ গোপনীয়তার কারণে কিছুই জানাতে পারছে না।

দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার ট্র্যাভেল করেসপন্ডেন্ট সাইমন কালডার বললেন, এভিয়েশন জগতে তাড়াহুড়ো আর চাপের মধ্যে মাঝে মাঝে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তবে এই ঘটনাটি ব্যতিক্রম। কারণ এটি বোর্ডিং গেটে ধরা পড়েনি, যেখানে সহজেই ভুলটা ঠিক করা যেত। তিনি বললেন, এয়ারলাইনের উচিত দ্রুত তদন্ত করা এবং সংশোধনীর ব্যবস্থা করা। এভিয়েশন সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ জুলিয়ান ব্রে বলেন, এখানে একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল। কারণ বিমানে যে যাত্রী তালিকা থাকা উচিত ছিল, সেটি ভুল ছিল। এটি অনুচিত এবং এমনটি ঘটা উচিত নয়। যাত্রী তালিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি, কারা কোথায় যাচ্ছে সেটির রেকর্ড রাখার জন্য। তবে বোর্ডিং পাস এবং লাগেজ ট্যাগে একই নাম থাকায় এবং বিমানে যাত্রী সংখ্যা ঠিক থাকায়, কিভাবে এটি ঘটেছে তা বোঝা যায় না। অন্যরা অবশ্য বলবেন, এটি আসলে নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল না। কারণ আমি এবং আমার ব্যাগ দুটোই যথাযথ নিরাপত্তা চেকের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। বৃটিশ এয়ারওয়েজের একজন মুখপাত্র বলেন, আমরা আমাদের গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং এই মানবিক ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছি। এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল। তবে আমরা পুনরাবৃত্তি এড়াতে ইতিমধ্যেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

হিথ্রো বিমানবন্দর একটি মন্তব্যে জানিয়েছে, এই ঘটনায় তাদের কোনো দায় নেই। কারণ গ্রাউন্ড ক্রু ও নিরাপত্তা স্ক্রিনিং তাদের আওতার বাইরে। আইবেরিয়া, যারা শুধু ফ্লাইটটি পরিচালনা করেছিল, তারা কোনো মন্তব্য দেয়নি। বিমানে পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাস সাধারণত ম্যানুয়ালি চেক করা হয় না, তাই এটিকে “অস্বাভাবিক” কিছু বলা যায় না। ক্ষমা ও তদন্ত যাই হোক, প্রশ্ন থেকে যায়- এমন উচ্চ নিরাপত্তার যুগে এই ঘটনা কীভাবে সম্ভব হলো? সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ধরনের ঘটনার অনেক উদাহরণ থাকলেও, সেগুলোর বেশিরভাগেই বোর্ডিংয়ের আগে ভুল ধরা পড়েছে- যেমন একই আসনে দুই ব্যক্তি বসতে যাওয়ায় এমন ঘটনা ধরা পড়েছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। কারণ আমার নাম সরিয়ে অন্য একজনের নাম বসানো হয়েছে, যিনি সম্ভবত স্পেনেই যাচ্ছিলেন না। আমি জানি না কখনো পুরোপুরি জানতে পারব কি না আসলে কী ঘটেছিল। তবে একটি জিনিস নিশ্চিত- ভবিষ্যতে আর কখনো বোর্ডিং পাসে লেখা প্রতিটি তথ্য ভালো করে না পড়ে আমি চেক-ইন ডেস্ক থেকে অগ্রসর হবো না।

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status