দেশ বিদেশ
গোলটেবিল বৈঠকে রাজনৈতিক দলের নেতারা
করিডোর নিয়ে নির্বাচিত সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে
স্টাফ রিপোর্টার
১ জুন ২০২৫, রবিবারমিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক করিডোর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা বিষয়ক এক গুরুত্বপূর্ণ গোলটেবিল বৈঠক হয়েছে। গতকাল রাজধানীর সিরডাপের এটিএম শামসুল হক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় বিভিন্ন রজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করেন, করিডোর নিয়ে নির্বাচিত সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সেন্টার ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যানালাইসিস এই বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কর্নেল (অব.) মো. জগলুল আহসান। তিনি আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, মানবিক করিডোরের তাৎপর্য, ঝুঁকি এবং বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরেন।
বৈঠকে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখতিয়ার নেই মানবিক করিডোর দেয়ার। সরকারের মূল কাজ হওয়া উচিত সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনা। অথচ সেই লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ দৃশ্যমান নয়। দেশের মানুষ এ তামাশা সহ্য করবে না, বলেন তিনি। অভিযোগ করে তিনি বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রথমে ‘নীতিগতভাবে মানবিক করিডোর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’ বলে মন্তব্য করলেও পরবর্তীতে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন যে, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের কাছ থেকে আমরা স্পষ্ট বার্তা পেয়েছি তারা বলেছে দুই রাষ্ট্রের সম্মতি ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি ছাড়া কোনো মানবিক করিডোর পরিচালনা সম্ভব নয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে কোনো করিডোর ছাড়াই রোহিঙ্গা ফেরত গেছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রোহিঙ্গাদের কেন করিডোরের মাধ্যমে ফেরত পাঠাতে হবে? আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রত্যাবাসন সম্ভব। এদিকে আরাকান রাজ্যে সিভিল যুদ্ধ চলছে, সেখানে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিভিন্ন পাইপলাইন রয়েছে এই জটিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে করিডোর ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে, এটি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বাংলাদেশ কোনো প্রক্সি যুদ্ধে জড়াবে না।
মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রধান উপদেষ্টা খুব সুন্দরভাবে কথা বলেন। করিডোর যদি দেয়া হয় তাহলে বাংলাদেশ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এটা গোপনীয় এজেন্ডা হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন একটা মাত্র দল ডিসেম্বরে ভোট চায় অথচ অনেক দল বলেছে তারা ডিসেম্বরে ভোট চায়। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় রাখতে পারি ততই দেশের জন্য ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন করিডোর নিয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত পরবর্তীতে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন এ ধরনের কিছু হয়নি এসব বক্তব্য স্পষ্ট করতে হবে। মানবিক দরজা দিয়েই তো রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। এখানে জাতিসংঘ ও পরাশক্তির স্বার্থ আছে, আমাদের স্বার্থ হচ্ছে তাদের ফেরত পাঠানো। মানবিক সহায়তার উছিলায় যদি ফেরত পাঠাতে পারি তা আমাদের বিরাট স্বার্থ। আমরা আর একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ দিতে চাই না। মানবিক করিডোর করা খুব কঠিন কাজ কারণ এখানে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও বাংলাদেশেকে চুক্তি করতে হবে। সকলের ঐক্যবদ্ধের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে সমাধান করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাদের রাজি করাতে হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য। ৯ মাসে ১ লাখ নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে এটাই সামাল দিতে পারেননি মানবিক করিডোর কীভাবে সামলাবেন? এ সরকারের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। ১৬ বছর মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এ সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ধরনের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় অথচ আমরাও বলেছি ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে দেশের জন্য ভালো। দ্রুত নির্বাচন দেয়া হোক তাহলে দেশের অনেক সংকট কেটে যাবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সেনাবাহিনী জনগণের কণ্ঠস্বরকে প্রতিনিধিত্ব করে বলেছে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র একটি নির্বাচিত সরকারই নিতে পারে। জনগণের মতামত ছাড়া জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অনুচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে সাইফুল হক বলেন, কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এটি একটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে স্পষ্ট করে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, স্টারলিংককে দেশে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে প্রতিযোগিতা বা মূল্যায়ন ছাড়াই। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়ে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, মানবিক করিডোরের নামে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, খাল কেটে আমরা কুমির আনবো না। এসব ইস্যুতে জনগণের মতামত নেয়া জরুরি এবং ভবিষ্যতে একটি নির্বাচিত পার্লামেন্ট এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। সাইফুল হক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যেন জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অবিলম্বে জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হয় এবং সংবেদনশীল ইস্যুতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, জণগণ এবং সেনাবাহিনী যখন এক হয়ে যায় তখন দেশের সঠিক স্বার্থ বোঝা যায়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মানবিক সহায়তা, কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক সংযোগের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে ৬ মাসের মধ্যে মিয়ানমারে শরণার্থীদের ফেরত পাঠিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বচ্ছতার অভাব। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন করিডোরের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত, পরবর্তীতে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন- দেয়া হয়নি। কুকি চিনের ৪৫ হাজার পোশাক পাওয়া গিয়েছে, এগুলো কি জন্য তৈরি করা হয়েছে তা জানতে হবে।
আলোচনায় আরও অংশগ্রহণ করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম এ আজিজ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব এডভোকেট হুমায়রা নূর, বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু আলিম মোহাম্মদ শাহিন খান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শাহিদুল হক, মাইকেল চাকমা এবং মেজর জেনারেল (অব.) মো. কামরুজ্জামান প্রমুখ।