দেশ বিদেশ
বাবার নামে মিল, জেল খাটছেন প্রবাসী সাদ্দাম
নাজমুল হক শামীম, ফেনী থেকে
২৯ জুন ২০২৫, রবিবার
ফেনীতে নিজের নাম নয়, বরং বাবার নামের সঙ্গে আংশিক মিল থাকায় মূল আসামির পরিবর্তে প্রবাস ফেরত এক যুবক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেনীতে দু’টি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে সৌদি প্রবাসী যুবক নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারীকে (২৬)। গত ১৬ই জুন রাতে তাকে ফেনী থেকে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। পরদিন তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি জেল খাটছেন ‘নিরীহ’ এই যুবক।
কারাবন্দি যুবকের পরিবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত সূত্র জানায়, গত ২৫শে মে ছুটিতে সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে দেশে ফেরেন প্রবাসী যুবক নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারী। তার গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আবুল খায়ের মিন্টু হাজারী। গত ১৬ই জুন রাতে ফেনী শহরের শহীদ হোসেন উদ্দিন বিপনী বিতান এলাকা থেকে নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরদিন তাকে ২০২৪ সালের ৪ঠা আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দু’টি হত্যাচেষ্টা মামলায় (জিআর-৪০৬/২৪ ও জিআর-৪২৭/২৪) গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। পরে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন।
মামলা দু’টি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের হাফেজ আহমদ এর ছেলে মহিউদ্দিন (৩৪) বিগত ২০২৪ সালের ৪ঠা আগস্ট দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহিপাল এলাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে মহিউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলার ঘটনায় ওই বছরের ১৯শে সেপ্টেম্বর তিনি বাদী হয়ে ফেনী সদর মডেল থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা (মামলা নং-২৭, জিআর-৪০৬/২৪) দায়ের করেন। ওই মামলায় এজহারনামীয় আসামি করা হয় ১৫৫ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ২০০ থেকে ৩০০ জনকে। মামলার এজহারনামীয় ১৪ নং আসামির নাম রিয়াদ (৩৪)। বাবার নাম- মৃত আবুল খায়ের, সাং মাধ্যম ধলিয়া, থানা- ফেনী সদর, জেলা- ফেনী।
একই দিন (২০২৪ সালের ৪ঠা আগস্ট) দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শহরের ট্রাংক রোডস্থ বড় মসজিদ এলাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের শাহাদাত হোসেনের ছেলে আফসার হোসেন (৩১)। এ সময় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে আফসার হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলার ঘটনায় ওই বছরের ৩রা অক্টোবর তিনি বাদী হয়ে ফেনী সদর মডেল থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা (মামলা নং-৭, জিআর-৪২৭/২৪) দায়ের করেন। ওই মামলায় এজহারনামীয় আসামি করা হয় ১৮৫ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে। মামলার এজহারনামীয় ৩৬ নং আসামির নাম রিয়াদ (৩২)। বাবার নাম- মৃত আবুল খায়ের, সাং মাধ্যম ধলিয়া, থানা- ফেনী সদর, জেলা- ফেনী, বর্তমান ঠিকানা- একাডেমী, ফেনী পৌরসভা ।
ওই দু’টি হত্যাচেষ্টা মামলার এজহারনামীয় একই আসামির বাবার নামের সঙ্গে আংশিক মিল থাকায় গত ১৬ই জুন রাতে ফেনী শহরের শহীদ হোসেন উদ্দিন বিপনী বিতান এলাকা থেকে এক প্রবাসী যুবককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃত ওই যুবকের নাম নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারী। বাবার নাম- মৃত আবুল খায়ের মিন্টু হাজারী। গ্রাম-মাসিমপুর, ইউনিয়ন-ধলিয়া, উপজেলা- ফেনী সদর, জেলা-ফেনী।
প্রকৃতপক্ষে মূল আসামির নাম ও তার গ্রামের নাম এর সঙ্গে কোনো কিছুর মিল না থাকলেও শুধু বাবার নামের সঙ্গে আংশিক মিল থাকায় র্যাব গ্রেপ্তার করে সৌদি প্রবাসী যুবক নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারীকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলার এজহারে থাকা আসামি রিয়াদ এর প্রকৃত নাম মো. নুরুল হুদা (এনআইডি নাম)। বয়স ৩৫। তিনি ফেনী পৌর যুবলীগের সহ সম্পাদক পদে রয়েছেন। ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সুশেন চন্দ্র শীলের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত। বিগত ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর নুরুল হুদা ওরফে রিয়াদ আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। র?্যাব তার অভিযানে আসামি রিয়াদের পরিবর্তে প্রবাসী যুবক নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারীকে আটকের পর দুই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে থানায় হস্তান্তর করে। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-৭ ফেনী ক্যাম্পের অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার মো. মিজানুর রহমান বলেন, মামলার (জিআর ৪০৬/২৪) এজহারভুক্ত আসামির রিয়াদকে (নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারী) আমরা গ্রেপ্তার করেছি। গ্রেপ্তারের পর মামলার বাদী আমাদেরকে (র্যাব) নিশ্চিত করেছে এই আসামি প্রকৃত রিয়াদ। এছাড়া পুলিশের রিক্যুজিশন করা তথ্যেও গ্রেপ্তার রিয়াদ এজহারনামীয় আসামি নিশ্চিত হয়েছি। আমরা আসামিকে পুলিশে হস্তান্তর করার সময়ও পুলিশ নিশ্চিত করেছে এটা প্রকৃত আসামি।
জিআর ৪০৬/২৪ মামলার বাদী মহিউদ্দিন বলেন, মামলার এজহারে আসামির পূর্ব নামের পরিবর্তে ভুলে ডাক নাম লেখা হয়েছে। এলাকাতে সে রিয়াদ নামে পরিচিত। তবে আসামির মূল নাম নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারী। সমপ্রীতি র?্যাব তাকে গ্রেপ্তার করেছে স্বীকার করলেও র?্যাব’র সঙ্গে আসামি শনাক্তের বিষয়ে কোনো রকম যোগাযোগ হয়নি বলে তিনি দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছি। এই মামলার বিস্তারিত তথ্য জানতে আপনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি আর বেশি কিছু আপনার বলতে পারছি না।’
জিআর ৪০৬/২৪ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন বলেন, মামলার বাদী আসমিকে শাক্ত করে র্যাব’র মাধ্যমে গ্রেপ্তার করিয়েছেন। মামলার বাদী আসামি উক্ত রিয়াদ পুলিশকেও নিশ্চিত করেছেন। আমার মামলা ছাড়াও আসামি রিয়াদকে আরও একটি মামলার এজাহারে নাম থাকায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
অপরদিকে জিআর ৪২৭/২৪ মামলার বাদী আফসার হোসেন বলেন, ‘আমার মামলার কোনো আসামিকে র?্যাব গ্রেপ্তার করেছে আবার আমাকে সেই আসামিকে দেখিয়ে কনফার্ম করেছে এমন কোনো ঘটনাই আমি জানি না। কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে সেটিও আমার জানা নেই। আমার মামলার বেশির ভাগ আসামি বিএনপি’র সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ঠিক করে দিয়েছেন। আমি চাই কোনো নিরীহ ব্যক্তি যেন আমার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে দুর্ভোগে না পড়ে। আমি কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মামলা করিনি, আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি রাষ্ট্রের কাছে প্রতিকার চেয়ে মামলা করেছি।’
মূল আসামির পরিবর্তে প্রবাসী যুবক জেলে বন্দি আছেন বিষয়টি জানতে চাইলে ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামছুজ্জামান বলেন, ‘এমন বিষয় তিনি অবগত নয়। কারাবন্দি ওই প্রবাসীর কোনো স্বজন গত ২৭শে জুন শুক্রবার রাত পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ওই প্রবাসীর স্বজনরা সঠিক কাগজপত্র নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হবে।’
প্রবাসী নজরুল ইসলাম সাদ্দাম হাজারীর বড় বোন ফেরদৌস আরা রিনা বলেন, ‘ছোটভাই গ্রেপ্তারের পর তারা আদালত, আইনজীবী ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই কারাবন্দি ভাইকে মুক্ত করার কোনো উপায় মেলেনি। মামলার বাদী মহিউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি আমাদের বলেছেন আমার ভাইকে রিয়াদ পরিচয়ে গ্রেপ্তারে তার কোনো হাত নেই। পাঁচ মাসের ছুটি শেষে আগামী ২২শে অক্টোবর ভাই নজরুল সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ভাই যদি জামিন না পায় তাহলে তার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
কারাবন্দি নজরুলের মা সেতারা বেগম বলেন, ‘২০২১ সালে ২৩শে নভেম্বর থেকে তার ছেলে সৌদি আরবে প্রবাস জীবন-যাপন করছে। বিগত চার বছরে সে তিনবার দেশে এসেছে। চলতি বছর দেশে এসেছে মুলত তাকে বিয়ে করানোর জন্য। ফুলের মতো নিষ্পাপ ছেলে কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না। কেউ ক্ষোভের বশে র্যাব দিয়ে তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। আমি অবিলম্বে ছেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।’
কারাবন্দি প্রবাসীর আইনজীবী ও ফেনী পৌর বিএনপি’র সদস্যসচিব এডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, প্রবাসী যুবক নজরুলকে যে দু’টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তিনি ওই মামলার আসামি নন। আমরা পর্যাপ্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। দু’-একদিনের মধ্যে আদালতে তার জামিনের আবেদন করা হবে। আদালত কাগজপত্র বিবেচনা করে অতি দ্রুত তাকে জামিন দেবেন বলে আশা করছি। সেইসঙ্গে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) থেকে প্রবাসী যুবক নজরুলের নাম বাদ দেয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানানো হবে।
পাঠকের মতামত
VIP Treatment in New Bangladesh