প্রথম পাতা
ঐকমত্য কমিশন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে অগ্রগতি
স্টাফ রিপোর্টার
৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক বৈঠকে এসব বিষয়ে দলগুলোর অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে কাছাকাছি এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা একমত হয়েছেন- নির্বাচন কমিশনের অধীনে দক্ষ, পেশাদার ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হবে। পাশাপাশি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সব রাজনৈতিক দল এ ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের অষ্টম দিনের বৈঠক শেষে এমনই মতামত জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, এই দু’টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করবে।
আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল- নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন।
বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করেছেন এবং এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঐকমত্য আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও কাঠামো এবং এর এখতিয়ার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কাছাকাছি এসেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনায় উল্লেখযোগ্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে আশু এবং দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন (যদি ইতিমধ্যে তা গঠিত হয়ে থাকে তবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে) এবং সেই কমিটির পরামর্শক্রমে সংসদীয় এলাকা নির্ধারণ করা।
দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রতি আদমশুমারি বা অনধিক ১০ বছর পরে সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ এর দফা ১ এর (গ) এর শেষে উল্লিখিত “এবং” শব্দটির পর ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিধান’ যুক্ত করা হবে। সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণ আইন ২০২১, যা ২০২৫ সালে সংশোধিত হয়েছে, তার ৮ (৩) সঙ্গে যুক্ত করে ঐ কমিটির গঠন ও কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আজকের আলোচনায় এটা স্পষ্ট বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করেছে। এ বিষয়ে সকলে ঐকমত্য। এর গঠন এবং কাঠামো বিষয়ে আলোচনা করেছি, কতোদিন থাকবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত এসেছে। দুটো সুপারিশ ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ৯০ দিন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ১২০ দিন। কোন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে, সেটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কাছাকাছি এসেছে। আজকের আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে তা অত্যন্ত ইচিবাচক।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনী এলাকা সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো গিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এটার উপর যেন একটি প্রবিশন সংবিধানে রাখা হয়। সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে একটি কমিটি করা যায় কিনা তাদের (কমিশনের) প্রস্তাব ছিল। প্রতি আদমশুমারির পরে কমিটি সীমানা নির্ধারণ করবে, এবং সেখানেই তাদের কার্যকাল শেষ হবে। আমরা বলেছি, আমরা যদি একটি আইনের মধ্যদিয়ে নিয়ে আসি তাহলে এটা ভালো। নির্বাচন কমিশনের যেটা দায়িত্ব পাওয়ার ফাংশনের মধ্যে উল্লেখ করা আছে, সেখানে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের জন্য একটি লাইন সংযোজন করা যায়। সেটা- ‘এবং’ শব্দের পরে আইনের দ্বারা নির্ধারিত একটি সময়ের জন্য বিশেষায়িত কমিটি বিধানের যুক্ত করা হবে। সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণের আইন ২০২১, যা পরে সংশোধিত ২০২৫। যা ৮ এর ৩ ধারা পরে যুক্ত করে এই কমিটির গঠন ও কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, কেয়ারটেকার সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সব দল একমত। কেয়ারটেকার সরকারের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে জুডিশিয়ারিকে বাদ রেখে, তার আগে দু’-একটি কি কি বিধান যুক্ত করা যায় দলগুলো এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে মতামত দেবেন। আমরা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করে এসেছি। যাতে আর কখনো ফ্যাসিস্ট তৈরি না হয়, ফিরে না আসে সেজন্য আমরা অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আগে নির্বাচন কমিশন নিজ উদ্যোগে সীমানা নির্ধারণ করতো। এবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য নির্বাচন কমিশনের অধীনেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে, যারা কমিশনকে সহযোগিতা ও সুপারিশ করবে।
তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে সংবিধান লঙ্ঘন করে বারবার নির্বাচনী এলাকা পরিবর্তন করা হয়েছে, যা মূলত ক্ষমতাসীনদের সুবিধার জন্য হয়েছে। তাই আদমশুমারি শেষে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি সীমানা নির্ধারণ করবে এবং এটি সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
এবি পার্টির ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, সীমানা নির্ধারণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নির্বাচনী আসন ঠিক করার জন্য প্রয়োজন। তবে প্রশ্ন হলো, এটি কোন পদ্ধতিতে হবে? বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে কাজটি করা হবে, নাকি নতুন করে আলাদা কোনো কমিশন গঠন করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেসব দায়িত্ব এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের থাকার কথা ছিল, তা তারা কার্যকরভাবে পালন করতে না পারায়, দুদকের হাতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকেও কাঙ্ক্ষিত সমাধান মেলেনি। তাই শুধুমাত্র নতুন প্রতিষ্ঠান করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। সেই ভিত্তিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে তিনি মত দেন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে অতীতে বারবার রাজনীতি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে ইতিমধ্যে ৫০০টির বেশি আপিল জমা পড়েছে, যেগুলোর শুনানি শুরু হয়েছে। কমিশনকে দক্ষ, পেশাদার ও যোগ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো দল বা ব্যক্তি সীমানা নির্ধারণকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক না থাকে।
বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। অন্যদিকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি সহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।