মত-মতান্তর
একজন বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
(৩ মাস আগে) ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ২:৫৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৭:৫০ অপরাহ্ন
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অহংকার। দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এমন মেধাবী ও আউটস্ট্যান্ডিং( outstanding) একাডেমিক ক্যারিয়ারের ব্যক্তিত্ব প্রধান বিচারপতি হিসেবে খুব কমই এসেছেন। এমন ব্যক্তিত্বকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তারা নি:সন্দেহে মেধা ও মেরিটকে প্রাধান্য দিয়েছেন, অন্য কিছুকে নয়।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে অন্য আরেকজন প্রখর মেধাবী প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি মোস্তফা কামাল। তাঁরও উজ্জ্বল একাডেমিক ক্যারিয়ার ছিল। ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) ও ইন্টারমিডিয়েটে (এইচএসসি) ছিল বোর্ড স্ট্যান্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) ও এমএ’তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নয় বরং গোটা কলা অনুষদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তবে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম এজন্য যে তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ ও দেশের বাইরের ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটিগুলোতে মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
গত এপ্রিল-মে’তে মাসব্যাপী বাংলাদেশ সফর শেষে ২০ মে লন্ডন ফিরি। ২৪ মে তৎকালীন হাইকোর্টের সিনিয়র বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুকে) একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। পাঠকদের সুবিধার্থে সেটি হুবুহু তুলে ধরলাম:
“বাংলাদেশ সফরকালীন সময়ে ঢাকায় সাক্ষাৎ হলো বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্টার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ মহোদয়ের সাথে। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বাংলাদেশের প্রতিথযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ মহোদয়ের সুযোগ্য সন্তান। অনেকক্ষণ তাঁর সাথে কথা হলো। আপাদমস্তক একজন অমায়িক ও বিনয়ী ব্যক্তিত্ব বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ অত্যন্ত মেধাবী বিচারক। Oxford Graduate বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের Tufts University থেকে। এর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (অনার্স)-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। জেষ্ঠ্যতার দিক দিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ হাইকোর্টে শীর্ষে (দ্বিতীয়) তথাপি তাঁকে এখন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে নেয়া হয় নি। বারবার তাঁকে ডিঙ্গিয়ে অনেক জুনিয়রদের আপীল বিভাগে নেয়া হয়েছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। আর মাত্র দেড় বছর আছে তাঁর অবসরে যাবার। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের ইংরেজী বলার স্টাইল ও জাজমেন্ট লেখার ধরণ এবং স্ট্যান্ডার্ড এক কথায় অসাধারণ। তাঁর সততা, যোগ্যতা, integrity এবং competency’র ব্যাপারে একটি নেতিবাচক কথা কখনও শুনিনি। তাঁকে আপীল বিভাগে নেয়া হলে এবং পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিলে বরং বহির্বিশ্বে দেশের ও দেশের বিচার বিভাগের সম্মান বাড়বে। ভারত ও পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতিরা যদি Harvard ও Cambridge- এর graduate হতে পারেন, আমরা কি সেই স্ট্যান্ডার্ডের আশা করতে পারি না?”
এই স্ট্যাটাস দেয়ার পর আওয়ামী ঘরনার আইনজীবী তো বটেই, বিএনপি ঘরনার অনেক আইনজীবী বন্ধু তখন আমাকে বলেছিলেন এটি অরন্যে রোদন (নিষ্ফল আবেদন)। এই সরকার শুনবে না। কত দ্রুত পরিবর্তন হলো আড়াই মাসের মাথায় - একেবারে আপসইড ডাউন! সুতরাং হক, সত্য ও ন্যায়ের কথা বলে যেতে হবে। কখন যে কাজে লাগবে তা বলা যায় না। সময় ও কালের গতির উপর কোনো ব্যক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সেই ব্যক্তি যতই ক্ষমতাশালী ও কর্তৃত্বশীল হোন না কেন।
বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের মতো উজ্জ্বল একাডেমিক ক্যারিয়ারের ব্যক্তিত্বকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় বহির্বিশ্বে দেশের ও দেশের বিচার বিভাগের সম্মান বাড়বে। আমরা এখন ভারত ও পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতিদের সাথে পাল্লা দিতে পারি। ভারতের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় হার্ভার্ডে পড়াশোনা করেছেন। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কাজী ফায়েজ ইসা লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়শোনা করেছেন। তাঁর আগের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। আমরা কি কম? আমরা এখন বলতে পারবো আমাদের প্রধান বিচারপতি অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন, পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের Tufts University’র Fletcher School of Law and Diplomacy থেকে।
শুধু ভারত বা পাকিস্তানের সাথে নয় বরং আমরা এখন তুলনা করতে পারি উন্নত বিশ্বের প্রধান বিচারপতিদের সাথে। ইউকে সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট (এখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধানকে প্রেসিডেন্ট বলা হয়) লর্ড রীড এডিনবারা ইউনিভার্সিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির Balliol College-এ পড়াশোনা করেছেন। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের লেডি চিফ জাস্টিস ক্যামব্রিজের Trinity College- এ পড়াশোনা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা এখন গর্বের সাথে বলতে পারি আমাদের প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ও বৃটেনের শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ডের Wadham College-এ পড়াশোনা করেছেন। ঐসব দেশের প্রধান বিচারপতিদের ইংরেজিতে লেখা ও কথা বলার স্টাইল ও ধরণ থেকে আমাদের প্রধান বিচারপতি কোনোভাবেই কম নন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরং বেশি।
বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ পতিত সরকারের সময় মারাত্মক অবিচারের শিকার হয়েছেন। তাঁর যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সিনিয়রিটি ও উজ্জ্বল একাডেমিক ক্যারিয়ার থাকার পরও তাকে আপিল বিভাগে নেয়া হয়নি। তাকে বারংবার সুপারসিড করে অনেক জুনিয়র, তাঁর চেয়ে অনেক কম অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন বিচারপতিদেরকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো- গত মে মাসে তাকে সুপারসিড করে তাঁর অনেক জুনিয়র বিচারপতিদের আপিল বিভাগে নেয়া হয়। এর মধ্য একজনের অবস্থা এমন যে - ২১ বছর আগে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ যখন হাইকোর্টের বিচারপতি হোন তখন ঐ ব্যক্তি সবেমাত্র অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়েছেন । অথচ এক অদৃশ্য সুতার টানে তাকে আপিল বিভাগে নেয়া হয়। ভাগ্যিস উনি ও তৎকালীন প্রধান বিচারপতিসহ প্রায় সবাইকে ছাত্র-জনতার চাপে আপিল বিভাগ থেকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে।
বিচারপতিরা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । তাঁরা ন্যায় বিচার করেন। এটা তাদের আইনি ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। মানুষের আশা-ভরসার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালত। আর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রতি যখন অবিচার করা হয় তখন তাদের হৃদয়ের যে কী অবস্থা হয় তা সহজেই বুঝা যায়। শুধু বুঝেন না অবিচারকারী কর্তৃপক্ষ। গত মে’তে যাদেরকে হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে নেয়া হয়েছে একজন ছাড়া সবাইকে অনেক সিনিয়র বিচারপতিদের ডিঙ্গিয়ে নেয়া হয়েছে। একজন সিনিয়র বিচারপতিকে অনেক বার সুপারসিড করার পর ব্যালেন্স করার জন্য তৎকালীন সরকার তাকে আপিল বিভাগে নিয়েছিল মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য কেননা তিন সপ্তাহ পরে তিনি অবসরে চলে যান। তিন সপ্তাহের জন্য হলেও তিনি তাঁর যথাযত elevation পাওয়ায় এত খুশি হয়েছেন যে আমার এক বন্ধুর কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে, তাঁর শারীরিক অনেক সমস্যা (ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ অনেক রোগব্যাধি) দূর হয়েছে এবং তাঁর শরীর অনেক হালকা লাগছে। এ থেকে সুপারসিডের মাধ্যমে অবিচারের শিকার হওয়া বিচারপতিদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও মনের অবস্থা সহজেই বোঝা যায়।
বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীও ছিলেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যোগ্যতা, মেরিট, সিনিয়রিটি ও বয়স - এ সব কিছুর বিবেচনায় তাঁরই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হবার কথা ছিল। কিন্তু তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হলো না। অথচ যাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিলো তাঁর থেকে সব কিছুতেই বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ছিলেন এগিয়ে। বয়সে উনার দেড় বছরের চেয়েও বড়, এডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন উনার দুই বছরেরও আগে, হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়েছেন উনার এক বছরেরও আগে, আপিল বিভাগে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়েছেন উনার প্রায় চার বছর আগে। সর্বোপরি হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন উনার ছয় বছরেরও আগে এবং আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন উনার দুই বছরেরও আগে।
জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলতেন “যে দেশে জ্ঞানীর কদর নেই সেই দেশে জ্ঞানীর জন্ম হয় না”। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে বলবো যে দেশে সততা, যোগ্যতা ও ইনটেগ্রিটির মূল্যায়ন করা হয় না, সে দেশে সৎ, যোগ্য ও ইনটেগ্রিটিসম্পন্ন লোক উঠে আসবে না। আশার কথা যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য, মেধাবী ও চৌকশ ব্যক্তিত্বদের নিয়োগ দিচ্ছেন। সর্বক্ষেত্রে এভাবে বৈষম্যকে দূর করে মেধার মূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তাঁর নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাক - এটাই প্রত্যাশা। আর এভাবেই অর্জিত হবে সফল গণ-অভ্যূত্থানের লক্ষ্য।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email:
[email protected]
Exec land