মত-মতান্তর
তিন শুন্য’র বাংলাদেশ: দক্ষতা উন্নয়ন হতে পারে পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি
সৈয়দ আব্দুল আজিজ
(১ মাস আগে) ১৪ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ৩:৪৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০২ পূর্বাহ্ন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০১৭ সালে তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ 'A World of Three Zeros' এর মাধ্যমে তিনটি বড় সংকট `দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ধারণা তুলে ধরেন, যা ‘তিন শূন্যের বিশ্ব’ হিসেবে সমাদৃত। ড. ইউনূসের মতে, “বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে ধনী শ্রেণির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরও বঞ্চিত হচ্ছে”।
তিনি মনে করেন, “প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়”। এজন্য তিনি তরুণ প্রজন্মকে চাকরি নামক দাসত্বের পরিবর্তে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার পরামর্শ দেন, যাতে তরুণ উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরিবেশ দূষণ ও বেকারত্বের সমাধান করতে পারে এবং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
ড. ইউনূস সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর, ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে যাতে করে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য-বেকারত্ব, সম্পদ বৈষম্য ও কার্বন নিঃসরণ সর্বনিম্ন মাত্রায় নামিয়ে আনা যায় এবং দেশটিকে ‘তিন শূন্যের বাংলাদেশ’ হিসেবে একটি প্রোটোটাইপ বা নমুনা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এক্ষেত্রে ‘তিন শূন্য’ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে বিবেচনা না করে ‘মেটাফোর’ বা রূপকার্থে ব্যবহার করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত ধারণা বলে মনে করা হয়।
সম্ভাবনার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ, সম্ভাবনাময় তারুণ্যের বাংলাদেশ। কীর্তিমান বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক ও সম্ভাবনাময় দেশ’।
এখানে বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তির পাশাপাশি রয়েছে ব-দ্বীপ বিধৌত উর্বর পলিমাটি, নদীবাহিত পানিসম্পদ এবং বঙ্গোপসাগরে সুনীল অর্থনীতির যাবতীয় উপাদান, যা প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করেছে। শতবর্ষের পরিক্রমায় (২০০১-২১০০) বাংলাদেশ বর্তমানে সর্বাধিক কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সময় অতিক্রম করছে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় ২৫ লাখ। ২০২৪ সালে মোট শ্রমশক্তির আকার ১১.৪ কোটি এবং ২০৩০ সালে এ আকার দাঁড়াবে ১২ কোটি। জনমিতি লভ্যাংশের (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) চলমান এসময়টি দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করার শ্রেষ্ঠ সময়। বিশ্বের উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশসমূহ জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। এদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তিকে যদি নৈতিকভাবে সৎ, কর্মে যোগ্য ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশটি অচিরেই দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ব দরবারে একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে।
কর্মসংস্থানের অপূর্ব সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাপী উন্নত রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে জনমিতির ফাঁদ বা ডেমোগ্রাফিক ট্র্যাপ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের পরবর্তী ধাপ) প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব দেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে । আমেরিকাভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘নেটকম লার্নিং’ এর মতে, শুধু উত্তর আমেরিকাতেই আগামী ১০ বছরে প্রতি বছর ১০ লক্ষ হারে মোট ১ কোটি আইটি কর্মীর কর্মসংস্থানের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও ক্লাউড-ভিত্তিক আউটসোর্সিংয়ের রয়েছে অফুরন্ত সুযোগ। জার্মান সরকার তার শ্রমবাজারে বিদেশিদের প্রবেশ সহজ করেছে। জাপান সরকার আশঙ্কা করছে, জনসংখ্যার সংকট অব্যাহত থাকলে তাদের জাতিসত্ত্বা বিলুপ্ত হতে পারে। জাপানে পাঁচটি নির্দিষ্ট পেশায় বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যেখানে বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় বাজার, তারা ২০৩০ সালের মধ্যে সব পেশায় প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ শ্রমশক্তি নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন হতে পারে এসব সম্ভাবনা কাজে লাগানোর মূল হাতিয়ার। শুধুমাত্র দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমেই বৈশ্বিক শ্রমবাজারে আগামী ১০ বছরে প্রতি বছর ১০ লক্ষ কর্মী পাঠানোর মাধ্যমে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশ হতে পারে বৈশ্বিক কর্মবাজারের জন্য দক্ষ জনশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে বহুমুখী উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
দক্ষতা উন্নয়নঃ টেকসই উন্নয়নের মূল নিয়ামক
কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা এবং উন্নয়ন মানদণ্ডে (Global Competitiveness and Development Index) কোনো দেশের উন্নয়নকে সে দেশের শ্রমবাজারের চাহিদাভিত্তিক দক্ষ শ্রমশক্তির সক্ষমতার দ্বারা পরিমাপ করা হয়। উদ্বেগজনকভাবে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমশক্তির নিম্নদক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতার নিম্নমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উপর আইএমইডি’র মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছে, "Low skill-low productivity of the employed workforce in all the 13 sectors of the economy stands as the daunting challenge to development and growth acceleration of the country” অর্থাৎ, অর্থনীতির নির্ধারিত ১৩টি খাতে কর্মরত শ্রমশক্তির নিম্ন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার নিম্নমান দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে ভীতিকর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ দেশে শিক্ষিত বেকারত্বের হার ৪৭% যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় (আফগানিস্তানের পরেই) হওয়া স্বত্তেও প্রায় ২৬ লাখ ভারতীয় এবং ৫ লাখ শ্রীলঙ্কান নাগরিক বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কর্মরত রয়েছেন, যা শ্রমশক্তির দক্ষতার ঘাটতিকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের কর্মক্ষম ১২ কোটি (১২০ মিলিয়ন) শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের হালচিত্র
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নানা মডেল গ্রহণ করা হলেও জনশক্তি উন্নয়নে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের সংগঠন 'বেটার বিজনেস ফোরাম'-এর সুপারিশক্রমে ‘জাতীয় দক্ষতা নীতি পরামর্শক কমিটি’ গঠন করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও বিভাগের মাধ্যমে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ অনুমোদিত হয়। বর্তমানে দক্ষতা উন্নয়ন সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যক্রম জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)-এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের আওতাধীন। ২০১৮ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৮ প্রণয়নের মাধ্যমে সংস্থাটির দায়িত্ব হিসেবে দক্ষতা উন্নয়ন সম্পর্কিত সমন্বয় সাধন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন, তথ্যভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা, স্কিলস কাউন্সিল গঠন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবস্থাপনার মতো কাজ নির্ধারণ করা হয়। তবে সম্প্রতি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে আইনি অসঙ্গতি, সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে অচলাবস্থার অভিযোগ উঠেছে। সংস্থাটিতে দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে আমলা নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উদ্ভাবনী কর্ম-পরিকল্পনা ও দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো কার্যক্রমে গতিশীলতা দৃশ্যমান নয়। শ্রমবাজারের তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠেনি, ইন্ডাস্ট্রি স্কিলস কাউন্সিল নামে মাত্র গঠিত হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশিদারিত্বমূলক কার্যক্রমে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নাই। ফলে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমের মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এজন্য দক্ষতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে এ খাতের প্রয়োজনীয় আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কর্মসূচিভিত্তিক সংস্কার সাধন করা আবশ্যক। অন্যথায় দক্ষতা উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি তথা আর্থ-সামাজিক টেকসই উন্নয়নে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ও বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষণা ও বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষিত!
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আশির দশকে দেয়া তাঁর এক অভিভাষণে জনশক্তি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “আমার বিবেচনায় অন্যান্য ক্ষেত্রের চাইতে এখানেই হতাশার কারণ বেশি। বৈষম্য রয়ে গেছে পুরুষ ও নারীর মধ্যে, বৈষম্য রয়ে গেছে নগর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে, আর সবার উপরে বৈষম্য রয়েছে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে, একটা সমাজ যা করতে পারে তা হচ্ছে (জনশক্তির) সৎ ব্যবহারের জন্য বৈচিত্র্যময় প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা করা।”
তিনি জনশক্তির বৈচিত্র্যময় কর্মপরিকল্পনাকে একটি জাতির উন্নয়নের মান নির্দেশক হিসেবে অভিহিত করেন। অপর শিক্ষাবিদ আব্দুর রফিক (যিনি স্বাধীনতার পর সকল শিক্ষা কমিশন/কমিটিতে কাজ করে যাওয়া বিরল শিক্ষাবিদ), ২০১৬ সালে Build Skill Bangladesh for Emerging Bangladesh as a Developed Nation এবং ২০২৩ সালে Emerging Nation Unveiling the Living Treasure শীর্ষক দুটি গবেষণার মাধ্যমে ১৯৫০ সাল থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনশক্তি এবং দক্ষতার সংকট বিশ্লেষণ করেন। তিনি শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদা ও সরবরাহ ঘাটতি বিশ্লেষণ করে তিনটি ধারাবাহিক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫, ২০২৬-২০৩০, ২০৩১-২০৩৫) মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ কোটি কর্মক্ষম নাগরিকের ১০ টি পেশাভিত্তিক দক্ষতা স্তরে উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থার মৌলিক পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেন এবং শিক্ষা শাসনকার্যের সকল মাত্রায় সংস্কারের অধিক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করেন। তাঁর গবেষণার প্রধান সুপারিশগুলোর মধ্যে, বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো (বিএনকিউএফ) ২০২১ সালে অনুমোদিত হলেও এর বাস্তবায়নে আইনি ও বিধিবিধানগত সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ কোটি কর্মক্ষম শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান কার্যক্রম নানা আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতায় পড়েছে। দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে, আর এ ধরনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর এখন আমলাদের চাকরির রুটিন কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন এবং তিন শুন্য’র বাংলাদেশ
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৩ বছরের বাংলাদেশ দেখেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুর স্বৈরশাসন, অপশাসন, বেকারত্ব, পরিবেশ বিপর্যয় এবং পুঁজি ও সম্পদের পাহাড়সম বৈষম্য। অবশেষে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে তরুণদের মনে জেগেছে এক নতুন স্বপ্ন—‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, সাম্যের বাংলাদেশ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। ছাত্র-জনতার এই গণবিপ্লবের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হলো- সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান। তাই ছাত্র-জনতার সম্মিলিত ঐক্যের বন্ধনে যে বিপ্লব চলমান রয়েছে, তার সাফল্যের প্রতীক হতে পারে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পরিবেশ বিপর্যয় ও বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ ও সৌহার্দ্যের বাংলাদেশ, অর্থাৎ তিন শূন্যের বাংলাদেশ।
সংস্কার ও ১২ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের অগ্রাধিকার!
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নবযাত্রা। এসব সংস্কারের মাধ্যমে দেশ অপশাসন থেকে মুক্ত হবে—এটাই জনগণের অগ্রাধিকার। কিন্তু ৫৩ বছরে দেশের দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থাটি যেখানে নির্জীব ও লক্ষ্যহীন হয়ে পড়েছে, যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, যেখানে দেশের ৪ কোটি যুবশক্তি বেকারত্বের অভিশাপে জীবন যাপন করছে, প্রতিবছর ২৫ লাখ নতুন শ্রমশক্তি কাজের সন্ধানে অনন্যোপায় হয়ে পৃথিবীর সর্বত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে প্রশ্ন জাগে—দক্ষতা উন্নয়ন খাতের অপরিহার্য সংস্কারকাজে আমরা কতটুকু অগ্রাধিকার দিচ্ছি?
একটি গল্প বলি। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের কথা, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে একজন সাংসদ (যিনি শ্রীলঙ্কার ‘মাস এডুকেশনের জনক’ হিসেবে সম্মানিত) দাবি করেন যে, শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের অর্ধেক বরাদ্দ দিতে হবে। পার্লামেন্টে সাথে সাথেই শুরু হলো হৈ চৈ। অনেক সদস্য তাকে পাগল বলে অভিহিত করেন। সাংসদ প্রত্তুত্তরে বললেন, ‘ঠিকই, আজ আমি পাগল! কিন্তু জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের অগ্রাধিকার নিশ্চিত না করা হলে পুরো জাতি পাগল হতে সময় লাগবে না।’
আজ ছাত্র-জনতার বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের জন্য একটি বড় প্রশ্ন: ২০৩০ সাল নাগাদ ১২ কোটি শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের অগ্রাধিকার কোথায়?
মাননীয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি সমগ্র বিশ্বকে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন! কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা তথা প্রধান নির্বাহী হিসেবে, এদেশের কোটি কোটি বেকার তরুণকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব থেকে মুক্ত করার কাজে আপনার অগ্রাধিকার আছে কি? বিগত চার দশকে দেশের একজন শিক্ষা কর্মী হিসেবে আমার অনুরোধ, এ কাজে আপনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিন। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আপনার মেয়াদ কোনো এক সময় শেষ হতে পারে, কিন্তু ১২ কোটি কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের একটি জাতীয় পথরেখা যদি আপনি তৈরি করেন, তাহলে এ অভিযাত্রায় আপনার নেতৃত্ব হবে এ জাতির সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের। আপনার কাছে বেকারত্বমুক্ত বাংলাদেশ কি ‘তিন শূন্য’র বিশ্ব তৈরির একটি মাইলফলক নয়?
লেখক-প্রফেসর জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস ইমেইল[email protected]
সুন্দর উপস্থাপনা। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশা করি, পরম শ্রদ্ধেয় ডঃ ইউনুস স্যার আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এর জন্য অবশ্যই আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যাবেন। আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি অতীব জরুরী জ্ঞান গর্ভ উপস্থাপনার জন্য। আল্লাহ তোমার সহায় হউন।
Congratulation to the thinker Pro.Dr.Syed Abdul Azij. Immediately action plan should taken by G O B.
সমকালীন বিশ্বে “তিন শুণ্যের পৃথিবী” ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সমাদৃত বিষয় । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শুণ্যত্রয়ের বাস্তবায়নে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অন্যতম একটি অনুষঙ্গ এবং যোগ্যতর উপাত্ত হিসেবে বিবেচনার জন্য লেখকের পরিবেশনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। আমাদের মানব সম্পদের ঐশ্বর্য্য বহুমাত্রিক । দেশে এবং বিদেশে এ সম্পদের সদ্ব্যবহারের প্রয়োজনে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত মানদণ্ডে তাদের উদ্ভাবনী দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবী । এ দাবীর প্রায়োগিক বাস্তবতা “তিন শুণ্যের বাংলাদেশ” বিনির্মানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ।
আলহামদুলিল্লাহ, স্যার সংক্ষেপে দারুণ লিখেছেন। সংশ্লিষ্টদের চিন্তা করতে সাহায্য করবে। আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতা উন্নয়নের যে সুযোগ সুবিধা রয়েছে সেগুলো যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করার কৌশল জানানো হয় তবে কিছুটা আগানো যেত।
ধন্যবাদ। লেখাটি বাস্তবধর্মী। লেখনীর মাধ্যমে একটা জাতি ভবিষ্যৎ পথ খুঁজে পায়। একটা দেশের অগ্রগতির জন্য দক্ষ জনবলের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জনবল অত্যাবশ্যক। তা না হলে অন্যায়, দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির লাগাম টেনে ধরা দূরহ। সাধুবাদ প্রিয় লেখককে সময়োপযোগী লেখনীর জন্য।
আসসালামু আলাইকুম, অসাধারণ লিখেছেন স্যার, আশা করছি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হবে।
লেখাটি চমৎকার ও সময় উপযোগী হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
দারুণ লেখা। পড়লাম।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ২৬ লাখ ভারতীয় এবং ৫ লাখ শ্রীলংকান বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কর্মরত আছে মর্মে লেখক উল্লেখ করেছেন, এই তথ্যের সূত্র উল্লেখ করলে আরো ভালো হতো।
চমৎকার। সময়োপযোগী একটি বিশ্লেষণমূলক লেখা উপহার দেওয়ার জন্য লেখক ও মানবজমিন পত্রিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ২৬ লাখ ভারতীয় এবং ৫ লাখ শ্রীলংকান বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কর্মরত আছে মর্মে লেখক উল্লেখ করেছেন, এই তথ্যের সূত্র উল্লেখ করলে আরো ভালো হতো।
সময়োচিত গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক দিকনির্দেশনা মূলক চমৎকার লেখা । সরকারের উচিত দক্ষতা উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রুপরেখার আলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া ।
চিন্তাশীল এবং যুগোপযোগী প্রবন্ধটি ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন বেকারত্ব দূরীকরণ ও বৈষম্য নিরাসনে উৎসাহিত করবে।
স্যার বরাবরই ভালো লেখে উনাকে লেখার আরও সুযোগ করে দেন কারিগরি শিক্ষা অনেক এগিয়ে যাবে এবং উনার লেখাগুলো যেন সরকার বাস্তবে রূপ দেয় এটাই কামনা করি
লেখাটি যুগোপযোগী ও চমৎকার হয়েছে।