মত-মতান্তর
ট্রাম্পের জয় এবং
ডা. ওয়াজেদ খান
(১ মাস আগে) ৭ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:০০ অপরাহ্ন
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ডেমোক্রেট প্রার্থী কমালা হ্যারিসকে পরাজিত করেছেন বড় ব্যবধানে। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস জয় দেশটির ১২০ বছরের ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে। অপরদিকে রাষ্ট্রের মূল তিনটি স্তম্ভ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগেও তিনি এবং তার দলের শতভাগ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন। তার আগামী শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও রাজনীতিতে সৃষ্টি করতে পারে ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতা এমনটা মনে করছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই নয়, ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টি নজিরবিহীনভাবে ১১৯ তম ইউএস কংগ্রেসেও করেছে বাজিমাত। কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে তাঁর দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো প্রেসিডেন্টই আসতে পারেনি এ ধরনের সুবিধাজনক অবস্থানে। সিনেটে এরই মধ্যে ৫২টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে রিপাবলিকান পার্টি। দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ৫১টি আসন। নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথে দলটি। হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২১৮টি আসনের মধ্যে রিপাবলিকানরা নিশ্চিত করেছে ২০০টি আসন। কেবল ইউএস কংগ্রেসে নয়, ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিচার বিভাগেও। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে দুই জায়গাতেই এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগে এই বিবেচনায় ডনাল্ড ট্রাম্প পেতে যাচ্ছেন একচ্ছত্র আধিপত্য। কয়েক দশকের ইতিহাসে ট্রাম্পই এমন প্রেসিডেন্ট, যার হাতের মুঠোয় বন্দি হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই সারা বিশ্বের ইতিহাস বদলে দেওয়ার সক্ষমতা। অনেক বিশ্লেষকদের মতে, এখন ডনাল্ড ট্রাম্প জিতে আসায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্যহীনতা ।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারে ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য ইউএস হাউস ও সিনেট নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিনক্ষণে ইউএস হাউজের ৪৩৫টি আসনের সবকটিতে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হলো ইউএস হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভস। ইউএস সিনেট হলো উচ্চ কক্ষ। দু’বছরে মেয়াদকালের জন্য নির্বাচিত হাউস সদস্যদেরকে বলা হয় কংগ্রেসম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইউএস হাউস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন হাউসে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তার পক্ষে আইনি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২১৮টি আসন। বর্তমান ১১৮তম কংগ্রেসের হাউজ রিপাবলিকান সদস্য সংখ্যা ২২০ জন। অপরদিকে ডেমোক্রেটদের সদস্য সংখ্যা ২১২ জন।
অপর দিকে ইউএস সিনেট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ। ৫০টি রাজ্য থেকে ২ জন করে মোট ১০০জন সিনেটর নিয়ে গঠিত। সাধারণের ভোটে নির্বাচিত সিনেটরদের মেয়াদকাল ৬ বছর। প্রতি দু’বছর অন্তর এক তৃতীয়াংশকে নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে হয় নতুন করে। এবার সিনেটের ৩৪টি আসনে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন । ডেমোক্রেটিক পার্টি সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তাদের বর্তমান আসন সংখ্যা ৫১। এবারের নির্বাচনে অতিরিক্ত ৩টি আসনে জিতে সিনেটও দখলে নিলো রিপাবলিকানরা। শুধু আইন বিভাগই নয় বিচার বিভাগের মূলকেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন বিচারকের মধ্যে ৫ জনই রিপাবলিকান। দেশটির ফেডারেল বিচার বিভাগের অধিকাংশ বিচারকও তাঁর আমলে নিয়োগ দেওয়া। ফলে এই বিচারকেরা কিছুটা হলেও কাজ করবেন ট্রাম্পের নীতির অনুকূলে । ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন নির্বাচিত হলে ২০২১ সালে ক্যাপিটল হিলে হামলাকারীদের সবাইকে দেয়া হবে দায়মুক্তি। সেই সাথে আদালতের আনুকুল্যে নিজেকে করবেন দায়মুক্ত। প্রথম মেয়াদে হোয়াইট হাউসে আসীন হওয়ার পর থেকেই নানাবিধ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন ডনাল্ড ট্রাম্প। দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন তিনি। তার জারিকৃত অনেক নির্বাহী আদেশ খারিজ করে দেন আদালত। সবকিছু মিলিয়ে তারপরও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মাঝে অটুট ছিলো ক্ষমতার ভারসাম্য। যা ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ নামে পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান তিনটি শাখা-আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ। আইন বিভাগ হলো ইউএস কংগ্রেস। এই বিভাগের কাজ হলো রাষ্ট্রের জন্য আইন প্রণয়ন করা। দ্বিতীয় হলো নির্বাহী বিভাগ। প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্টের মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে গঠিত এ বিভাগ। কংগ্রেসে প্রণীত আইন কার্যকর করাই নির্বাহী বিভাগের মুখ্য কাজ। তৃতীয় হলো বিচার বিভাগ। যা সুপ্রিম কোর্ট এবং দেশ ব্যাপী বিস্তৃত অন্যান্য ফেডারেল কোর্ট নিয়ে গঠিত। বিচার বিভাগ, সংবিধান ও আইন পর্যালোচনা করে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে কোর্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সরকারের প্রধান এই তিন স্তম্ভের মধ্যে সংযুক্ত করা হয়েছে চমৎকার ও কার্যকর এই ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি। সংবিধানের ১নং ধারায় ২৩৫ বছর আগে ১৭৮৭সালে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ সন্নিবেশিত করা হয়। আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারগণ। সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য প্রসঙ্গে অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার জেমস ম্যাডিসন এক মন্তব্যে বলেন, “মানুষ ফেরেশতা হলে রাষ্ট্রে কোনো সরকারের প্রয়োজন হতো না।” এ কারণেই সরকারে অপরিহার্য হয়ে উঠে ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ব্যবস্থায় আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ নিজ নিজ এখতিয়ারভুক্ত ক্ষমতার বাইরে যেতে পারে না। কোনো একটি শাখা ক্ষমতার অপব্যবহার করার চেষ্টা করলেই আটকে দেয় অপর দুই শাখা। যেমন প্রেসিডেন্টের একটি নির্বাহী আদেশ আটকে দিতে পারে আইন বিভাগ সিনেটের। আবার আইন বিভাগের প্রণীত একটি বিলে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন প্রেসিডেন্ট। কংগ্রেসে গৃহীত আইন চূড়ান্ত পাশের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর যেখানে প্রয়োজন। ভেটো শক্তি বলে প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর না করলে সেই বিল কংগ্রেসে সংখ্যাধিক্যের ভোটে গৃহীত হয়ে যাবে।
কংগ্রেসের পাসকৃত আইন জুডিশিয়াল রিভিউ ক্ষমতা বলে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে আটকে দিতে পারেন সুপ্রিম কোর্ট। আবার কংগ্রেস সংবিধানে সংশোধনী এনে অকার্যকর করতে পারে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ। সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে বাতিল করতে পারে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ। অথচ এই প্রেসিডেন্টই নিয়োগ দেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের। আর এভাবেই সরকারে বজায় রাখা হয় ভারসাম্যতা। চেক্স অ্যান্ড ব্যালেন্সের প্রক্রিয়াকে প্রতীকী তুলনা করা হয় কাগজ, কাঁচি এবং পাথরের সাথে। এক্ষেত্রে আইন বিভাগকে কাগজ, নির্বাহী বিভাগকে কাঁচি এবং বিচার বিভাগকে তুলনা করা হয় পাথরের সাথে। যেমন আইন বিভাগের একটি বিলের কাগজে কাঁচি চালাতে পারেন প্রেসিডেন্ট। আবার সেই কাঁচিকে পাথর মেরে গুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে কোর্ট। পক্ষান্তরে আইন বিভাগের কাগজ ক্ষমতা বলে ঢেকে দিতে পারে গোটা পাথরকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশে দেশে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ হয়ে উঠেন স্বেচ্ছাচারী। ফলে রাষ্ট্রে কায়েম হয় এক নায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ। এক ব্যক্তিই নিয়ন্ত্রণ করেন সবকিছু। আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয় দেশের মানুষ। রাজনৈতিক কারণে সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরে ভারসাম্যহীনতা কাজ করলে তা গোটা জাতির জীবনে টানতে পাওে দীর্ঘমেয়াদী বিভক্তি রেখা।
-সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক