ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪ রজব ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

একটি দেয়াল লিখন ও সিরিয়ার স্বৈরশাসকের পতন

ডাঃ ওয়াজেদ খান

(১ মাস আগে) ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ৯:১৬ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৭ পূর্বাহ্ন

mzamin

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এক কিশোরের একটি দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি বদলে দিয়েছে সিরিয়ার ভাগ্য। সশস্ত্র বিপ্লব পতন ঘটিয়েছে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার। বিদ্রোহীদের মাত্র ১২দিনের অভিযানে যবনিকা ঘটলো দীর্ঘ ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের। অবসান হলো নিপীড়ন-নির্যাতনের দুই যুগ। হায়াত তাহরির আলশাম-এইচটিএস নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী নাটকীয়ভাবে সফল করেছে এই বিপ্লব। বলতে গেলে বিনা রক্তপাতে বিপ্লবটি ঘটে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থানের ৪ মাস ৩দিনের মাথায়। বাশার আল আসাদও বেছে নিলেন ফ্যাসিস্ট হাসিনার মতো পলায়নের পথ। বিপ্লবীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসার আগেই একটি বিমানে করে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট বাশার। এইচটিএস প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নেতৃত্ব দিয়েছেন বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড ও কমান্ডার হিসেবে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করছেন বাশারের পতনের পর। প্রেসিডেন্ট বাশারের প্রয়াত পিতা হাফিজ আল আসাদের সব মূর্তি এবং স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে জনগণ।

পলাতক প্রেসিডেন্ট বাশার এবং তার পিতা হাফিজ আল আসাদ মিলে মোট ৫৪ বছর শাসন করেছেন সিরিয়া। ১৯৭১সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তার পিতা ক্ষমতাসীন ছিলেন। হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন বাশার আল-আসাদ। এজন্য পরিবর্তন করতে হয় দেশটির সংবিধান। যাতে বিধান ছিল প্রেসিডেন্টের সর্বনিম্ন বয়স ৪০ বছর থাকার। প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাস পর আসমা আল-আখরাসকে বিয়ে করেন তিনি। বাশার আল আসাদ আলাবী শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। অবশ্য তার স্ত্রী আসমা সুন্নী পরিবারের। তাদের তিন সন্তান- হাফিজ, জেইন এবং কারিম। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে কঠোর হাতে তিনি বিরোধীদের দমন ও দেশ শাসন করেন। শাসনের দীর্ঘ এ সময় ধরে জনগণের সকল অধিকার হরণ করেন বাশার আল-আসাদ। এসময় ব্যাপক নিপীড়ন- নির্যাতনের যাতাকল থেকে অনেকবার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে সিরিয়ার জনগণ। আরব বসন্ত সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় সিরিয়ানদেরকে।

উত্তর আফ্রিকার আরব দেশ তিউনিসিয়ায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মোহাম্মদ বোয়াজিজ নামে একজন ফল বিক্রেতা আত্মাহুতি দেন শরীরে আগুন লাগিয়ে। প্রেসিডেন্ট জয়নাল বিন আলীর স্বৈরাশাসনের প্রতিবাদে এই পন্থা বেছে নেন তিনি। তিউনিসিয়ায় শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। দেশ ছেড়ে পালান বিন আলী। সেখান থেকে আরব বসন্তের ঢেউ লাগে অন্যান্য আরব দেশে। একে একে পতন ঘটতে থাকে স্বৈরশাসকদের।

আরব বসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়ে সিরিয়াতেও। সেখানেও অভিনব কায়দায় সূত্রপাত ঘটে আন্দোলন সংগ্রামের। সিরিয়ার একমাত্র রাজনৈতিক দল বাথ পাটি এবং বাশার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সবপথ ছিলো রুদ্ধ। এমন কঠিন সময়ে একটি দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি একে বাশার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূচনা করে ১৪ বছরের এক কিশোর। জর্দানের সীমান্তবর্তী সিরিয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের ছোট একটি শহর দারাহ। সেখানকার রাস্তায় পাশের দেয়ালে একটি গ্রাফিতি আঁকে মুয়াবিয়া সায়সানেহ নামের সপ্তম শ্রেণির একজন ছাত্র। মুয়াবিয়া গ্রাফিতিতে স্প্রে করে মাত্র কয়েকটি শব্দে লিখেছিলো-‘এজাক এল দরজা ডাকতুর।’ যার অর্থ ‘ডাক্তার এবার তোমার পালা।’ বাশার আল আসাদ একজন চক্ষু চিকিৎসক। তাই তাকে উদ্দেশ্য করেই গ্রাফিতি আঁকে মুয়াবিয়া। গ্রাফিতিটি নজরে আসে বাশার সরকারের গোয়েন্দাদের। তারা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে গ্রাফিতির শিল্পীকে। মুয়াবিয়াকে শনাক্ত করতে না পেরে কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে ২৬ দিন ধরে চালায় অকথ্য নির্যাতন। এই ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। দাবানলের মতো গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে জনগণ। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ প্রথবারের মতো সিরিয়ায় দানা বেঁধে উঠে দুর্বার আন্দোলন। পরবর্তীতে শুরু হয়ে যায় বর্তমান শতকের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। বাশার আল আসাদকে নিয়ে মুয়াবিয়ার গ্রাফিতি স্মারক হয়ে উঠে সিরিয়ায় জাতীয় বিদ্রোহের। মুয়াবিয়ার এ গ্রাফিতিই বদলে দিয়েছে সিরিয়ার ভাগ্য।

সিরিয়ায় টানা ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির শহর, বন্দর, গ্রাম। সিরিয়ার এ গৃহযুদ্ধে স্বৈরাশাসক বাশারের পাশে দাঁড়ায় রাশিয়া, ইরানসহ কয়েকটি শক্তি। ভেঙে যায় সিরিয়ার সেনাবাহিনী। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে বিদ্রোহীরা। যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশও জড়ায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে। আইসিস, কুর্দি সশস্ত্র গ্রুপ ছাড়াও বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপ অংশ নেয় পৃথকভাবে। বাশার আল আসাদ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে নির্মমভাবে হত্যা করে নিজ দেশের মানুষকে। গৃহযুদ্ধে সম্পৃক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয়। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে জিইয়ে রাখে গৃহযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে গৃহযুদ্ধের বিরতি টানা হলেও থেমে যায়নি বিদ্রোহীদের তৎপরতা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত ৮ ডিসেম্বর। গৃহযুদ্ধে বাশারের মূল সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছিলো রাশিয়া। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে একদিকে রাশিয়ার ক্লান্তি, অপরদিকে ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বিরতিতে ইরানের হতাশা এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের  যুদ্ধ বর্জন নীতি উৎসাহী করে তোলে ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম -এইচটিএসকে। গত ২৭ নভেম্বর আলেপ্পো শহর দখলের মাধ্যমে মোক্ষম সময়টি কাজে লাগায় এইচটিএস।

বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে এখন পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন ৪২ বছর বয়সের আবু মোহাম্মেদ আল-জোলানি। সিরিয়ার রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জড়িত থাকার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এত দিন অনেকটা আড়ালে থেকেই  জোলানি নেতৃত্ব দিতেন সিরিয়ায় সরকারবিরোধী অভিযানগুলোয়। জোলানির আসল নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। সৌদি আরবের রিয়াদে ১৯৮২ সালে তার জন্ম। সেখানে পেট্রোলিয়াম প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার বাবা। তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে ১৯৮৯ সালে। বাস করতে শুরু করেন রাজধানী দামেস্কের কাছে। ২০০৩ সালে গিয়ে আল-কায়েদায় যোগ দেন আল-জোলানি। ইরাকে ২০০৬ সালে মার্কিন বাহিনী তাকে ইরাকে গ্রেপ্তার কওে বন্দি করে রাখে পাঁচ বছর। বিপ্লবের সব ধরনের প্রতিশোধপরায়ণতা পরিহার করে সিরিয়াকে নতুন করে গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন জোলানি। এইচটিএসের প্রধান আবু মোহাম্মদ আল জোলানি এই ঘোষণা দেন। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় এজন্য আরো কিছুটা সময় থাকতে হবে অপেক্ষায়।

পশ্চিম এশিয়ার দেশ সিরিয়া ভূ-মধ্য সাগরের পূর্ব উপকূলের একটি ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্য দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছায় সিরিয়া। বিশেষ করে মুসলমানদের নিকট অন্যতম একটি পূণ্যময় স্থানের মর্যাদায় রয়েছে দেশটি। প্রাচীন সিরিয়ার নাম ছিলো শাম। একসময় জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন সহ পুরোটাই ছিলো শাম’র অধীন। সিরিয়ার কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত আছে। সভ্যতার উষালগ্নে সিরিয়াতেই প্রথম চাষবাস ও গবাদি পশু প্রজননের বিস্তৃতির কথা জানা যায়। প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশটির আয়তন প্রায় ৭২ হাজার বর্গমাইল। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ মুসলিম, ১০ শতাংশ খ্রিষ্টান ও ৩ শতাংশ দ্রুত। মুসলমানদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ সুন্নি হলেও মাত্র ১২ শতাংশ আলাবী শিয়া সম্প্রদায় শাসন করে আসছে সিরিয়া। কুর্দি মুসলমানরাও সিরিয়ার একটি অংশ জুড়ে নিজেদের পৃথক ভূমি দাবি করে আসছে। সবকিছু মিলিয়ে সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।

সিরিয়ার এই বিপ্লবে তুরষ্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে সংবাদ চাউড় আছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোগান এক বিবৃতিতে বলেছেন ‘সিরিয়ার ভূমি যুদ্ধ, রক্ত ও অশ্রুতে পূর্ণ।’ আমরা সিরিয়াকে শান্তি ও স্বস্থিময় রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই।” এদিকে ইসরাইল গোলান হাইটস এলাকায় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অতিক্রম করেছে সিরিয়ান সীমান্ত। মোতায়েন করেছে নিরাপত্তা রক্ষী। এমন পরিস্থিতিতে পর ইরান, কাতার, সৌদি আরব, জর্ডান, মিসর, ইরাক, তুরস্ক এবং রাশিয়া এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যেতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু ঠিক মনে হলেও ভিন্ন কোনো আশঙ্কার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না এই মুর্হূতে ।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ।

নিউ ইয়র্ক।

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Hamdard

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status