ঢাকা, ২১ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার, ৭ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

মানবাধিকার নিয়ে যেসব সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন

স্টাফ রিপোর্টার
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার

নাগরিকদের মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিতে বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনও মানবাধিকার নিশ্চিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে ক্ষমতায়ন করার সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন মানবাধিকার কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার সুপারিশ করেছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন মানবাধিকার নিশ্চিতে যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন জরুরি বলে উল্লেখ করেছে। 

মানবাধিকার নিশ্চিতে পুলিশ সংস্কার কমিশন মোট ৬টি সুপারিশ করেছে। যেগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছে সংস্কার কমিশন। ৬টি সুপারিশ হলো-
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সমস্ত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা; আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বা তাদের প্ররোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাপ্রধান নিজেই যাতে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়েও একটি মানবাধিকার সেল কার্যকর থাকা; সংবিধান, বিভিন্ন আইন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পুলিশ কর্তৃক অমান্য করার দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার জন্য নতুন হেল্পলাইন চালু করা কিংবা ট্রিপল নাইন (৯৯৯) কর্তৃক সেবার মধ্যে এ ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করা; ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষার জন্য একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা উচিত, যা জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে; পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং জনবান্ধব পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র?্যাবের (র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়ন করা; জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করা।  এ ছাড়াও বন্দিদের পরিবহন ও হাজতের পরিবেশ নিয়েও পৃথক সুপারিশ দিয়েছে সংস্কার কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে- পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা হাজত ও কোর্ট হাজতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা-নেয়ার সময় ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হলো। 

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সংস্কার রিপোর্টের মানবাধিকার ও আইনের শাসন অংশে বলা হয়েছে, পুলিশ রাষ্ট্রের অপরাধ বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুলিশ এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে এবং নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখতে কাজ করে। এ কাজে কখনো কখনো শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় বটে, তবে সেটা আইনসিদ্ধ সীমার মধ্যে রাখা জরুরি। এই দ্বন্দ্বটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পুলিশের নাগরিক সনদ অনুযায়ী তাদের লক্ষ্য হলো- সকল নাগরিককে নিরাপত্তা সেবা প্রদান করা এবং বসবাস ও কর্মোপযোগী নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আর প্রধান উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে: আইনের শাসন সমুন্নত রাখা; সকল নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। সংস্কার রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশকে জনগণের জন্য এমন একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে যেখানে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারসহ আইনের শাসন সুরক্ষিত থাকবে। এই লক্ষ্যে পুলিশ সদস্যদের দক্ষতা ও ইতিবাচক ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে, যা সংবিধানের চেতনা এবং সর্বজনীন মানবাধিকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। আজকের দিনে পুলিশের জবাবদিহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উন্নত বলপ্রয়োগের ক্ষমতা এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম থাকার কারণে তাদের আরও কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনয়ন করা এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সামপ্রতিককালে বাংলাদেশ পুলিশের বিদ্যমান জবাবদিহিতার ব্যবস্থাটি কেবল অকার্যকরই হয় নাই, বরং এটি জনগণের আস্থাও হারিয়েছে। বর্তমানে এমন অনেক আইন, নিয়ম ও নির্দেশনা বলবৎ রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে পুলিশের ক্ষমতার সীমা ও তাদের জবাবদিহিতার জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে। একইসঙ্গে মানবাধিকার রক্ষার জন্য তাদের ওপর কঠোর নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও পুলিশ প্রায়শই নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে। এর ফলে পুলিশের ওপর জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা কমে গেছে এবং জনগণের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পরিবর্তে পুলিশ এখন তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে। জানমাল রক্ষা এবং জনসেবা পুলিশের মূলনীতি হলেও, সেটি অর্থহীন হয়ে পড়ে যখন জনগণই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে এবং ভয় পায়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা এই বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। 

রিপোর্টে বলা হয়, দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানসহ বিদ্যমান অন্যান্য আইনে স্পষ্টভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং বেআইনি গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়াও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক সনদ মেনে চলতে বাধ্য, যার অনুচ্ছেদ ৫-এ বলা হয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির সম্মুখীন করা যাবে না’। আর বাংলাদেশ আইসিসিপিআর-এর সদস্য-রাষ্ট্র, যার অনুচ্ছেদ ৭ এ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির সম্মুখীন করা যাবে না’। অন্যদিকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের জনবান্ধব পুলিশ ব্যবস্থা গঠনে র?্যাবের প্রয়োজনীয়তার পুনর্মূল্যায়ন অংশে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর সংশ্লিষ্টতার প্রতি ইঙ্গিত করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন এবং বেআইনি গ্রেপ্তারের মতো গুরুতর অভিযোগের কারণে র‌্যাব দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ২০০৩ সালে যে প্রয়োজনের ভিত্তিতে র‌্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ২০২৫ সালে এসে নতুন করে মূল্যায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বাস্তবতায় র?্যাবের কার্যক্রমের পরিধি, এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং এর সার্বিক প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সুসংহত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্য এবং তাদের নির্দেশদাতাদের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ এটি কেবল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং পুলিশের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গঠনের জন্য অপরিহার্য। গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঘটে যাওয়া সহিংসতা জনগণের মনে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে পুলিশ-জনসম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের বৈধতা দেয়ার সমান হবে, যা ভবিষ্যতে আরও দমনমূলক আচরণের পথ প্রশস্ত করতে পারে। সঠিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি প্রদান করলে এটি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এবং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করবে। একইসঙ্গে, এই পদক্ষেপ জনগণের কাছে একটি বার্তা দেবে যে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে এবং অন্যায় প্রতিরোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি পুলিশকে সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব হয়ে উঠতে সহায়তা করবে। আর বন্দিদের পরিবহন ও হাজতের পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বন্দিদের জেলহাজত, কোর্ট হাজত এবং কোর্টে আনা-নেয়ার সময় ব্যবহৃত যানবাহনের আধুনিকায়ন ও পরিচ্ছন্নতার মান উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত যানবাহনগুলো অনেক সময় অপ্রতুল, অস্বাস্থ্যকর এবং প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাবে বন্দিদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এ লক্ষ্যে, বন্দিদের পরিবহনের জন্য আধুনিক ও নিরাপদ, মানবিক সেবার সুবিধা যুক্ত যানবাহন সংগ্রহ করা প্রয়োজন, যেখানে পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রযুক্তি সংযোজিত থাকবে। পাশাপাশি, যানবাহনগুলোর নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং বন্দিদের জন্য সুস্থ ও মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। একই সঙ্গে, জেলহাজতের পরিবেশকে আরও উন্নত, পরিচ্ছন্ন এবং মানবিক করা অত্যন্ত জরুরি, যা বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে সহায়তা করবে। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের ফৌজদারি বিচারিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়াবে এবং বন্দিদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করবে। এদিকে নাগরিকদের মানবাধিকার নিশ্চিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status