দেশ বিদেশ
ভারতের ব্যতিক্রমী চায়ের দোকান
মানবজমিন ডেস্ক
২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
মার্চের উষ্ণ সকাল। বাড়ি থেকে সাইকেলে করে ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে সেরামপুরের ছত্রপাড়ায় চায়ের দোকানে যান আশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। তার পরনে ছিল গোলাপি রংয়ের একটি পোলো শার্ট। সেখানে উপস্থিত হয়ে দোকান খোলেন তিনি। বলেন, আজ আমার পালা। একটি নতুন পাত্রে চা তৈরির সময় তিনি বলেন, আমি এখানে কাজ করি না। আমি এখানকার একজন ক্রেতা এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে ভালোবাসি। ওই দোকান ‘নরেশ সমশেরের চায়ের দোকান’ নামে পরিচিত। ভারতে চা প্রস্তুত ও ভাগাভাগি করাকে সামাজিক বন্ধনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক শতাব্দী ধরে চায়ের দোকান বিশ্রাম ও কথোপকথন ভাগাভাগি করার একটি স্থান হয়ে উঠেছে। তবে ক্রেতারা চা প্রস্তুত করে তা নিজেরা পরিবেশন করার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন আরও এক ধাপ এগিয়েছে। আশিষ একটি নির্র্মাণ কোম্পানি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তার বয়স যখন ১০ তখন থেকেই ওই চায়ের দোকানে তার যাতায়াত। এখানেই তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং চা পান করেন। প্রতি সপ্তাহের শুরুতে সকালে দোকানের মালিক অশোক চক্রবর্তী (৬০) দোকান খুলে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যান। আশিষ বলেন, অশোকের ফিরে আসা পর্যন্ত আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন দোকানের দায়িত্ব নেন। আমাদের ১০ জন সেচ্ছাসেবকের একট দল আছে। সপ্তাহে একদিন এদের মধ্য থেকে একজন দোকান খোলার দায়িত্ব নেন। দোকানের অধিকাংশ ক্রেতাই আশিষের মতো, যারা তাদের কর্মস্থল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। এদিন আশিষ সকাল ৯ টায় দোকানে এসেছেন। এরপর মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য দোকান বন্ধ করেন। বেলা ৩টায় পুনরায় তিনি দোকান খোলেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন না হলেও আমি সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন এখানে থাকতে পছন্দ করি। আমি চলে যাওয়ার পর অন্য কেউ দোকানে বসবেন। এখানে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। যার হাতে যখন সময় থাকে সে তখন দোকানে বসেন। দুধ ও চিনি কেনার পর আমরা কাঠের বাক্সে টাকা রেখে দেই। ১০০ বছরে ৫ বাই ৭ ফুটের চায়ের দোকানটিতে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। সিলিং মেরামত করা ছাড়া আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি সেখানে। দেয়ালে কয়েক স্তর রঙ থাকা সত্ত্বেও স্টোভের আগুনে সৃষ্ট কালো ধোঁয়ায় তা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। এখনো পর্যন্ত সেখানে মাটির কাপের পাশাপাশি কাগজের কাপে করে চা পরিবেশন করা হয়। মূল্য মাত্র ৫ রুপি। ক্রেতারা তাদের পছন্দমতো চিনি বা চিনি ছাড়া দুধ চা নিতে পারেন। এ ছাড়া সেখানে লেবু দিয়ে রঙ চা পরিবেশন করা হয়। আরও আছে কবিরাজি চা। যা মূলত মসলাযুক্ত লাল চা। জারে সাজানো আছে কয়েক ধরনের বিস্কুট। দোকানটি ছত্র কালি বাবুর শ্মশানের পাশে অবস্থিত। ফলে অনেকেই প্রিয়জনকে শেষ বিদায় জানিয়ে সেখানে বসে এক কাপ চা পান করেন। উল্লেখ্য, দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন নরেশ চন্দ্র সোম। তিনি ব্রুক বন্ড নামের চায়ের কোম্পানিতে কাজ করতেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চাকরি হারান। ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারত। এরপর সোম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ২৫ বছর আগে একজন সহকর্মী কীভাবে ওই চায়ের দোকানে টেনে আনেন সে বিষয়ে মন্তব্য করেন প্রশান্ত মণ্ডল নামে একজন নিয়মিত খরিদ্দার। এদিকে দোকানে গ্যাস সরবরাহকারী এজেন্ট বলেন, সেরামপুরে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান আছে। তবে আমি সব সময় এখানেই আসি। চা শেষ করার পর পুনরায় চুলায় কয়লা দিতে আশিষকে সাহায্য করেন প্রশান্ত। উল্লেখ্য, বেশির ভাগ ক্রেতাই দুধের প্যাকেট এনে বা ট্যাপ থেকে পানি ভরে সাহায্য করে থাকেন। আশিষ বলেন, আমরা নরেশ সোমের সময়কার গল্প শুনেছি। জনসেবার কাজে বা পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেলে তিনি প্রায়ই দোকান ফেলে চলে যেতেন। ক্রেতাদেরকে দোকানের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। তিনি আরও বলেন, আমার বিশ্বাস এখনো ওই ধারা অব্যাহত আছে। দোকানের গ্রাহকরা মালিকের অনুপস্থিতিতে দোকানের দায়িত্ব নেয়াকে তাদের দায়িত্ব মনে করেন। ১৯২৫ সালে সোম তার খালার মালিকানাধীন ভবনে নিচতলায় চায়ের দোকান দেন। এর আগে ওই ভবনে বেশ কয়েক রকমের জিনিসের দোকান ছিল। একটিতে থালাবাসন বিক্রি করা হতো। সেরামপুরে ২ লাখের মতো মানুষ বসবাস করেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা সৃষ্টির কয়েক শতাব্দী আগেই এই শহরের উদ্ভব হয়। ১৭৫৫-১৮৪৫ পর্যন্ত ওই শহর বৃটিশ ও ড্যানিশরা শাসন করেছে। স্থানীয় পুনরুদ্ধার কর্মী মোহিত রণদীপ বলেন, ওই চায়ের দোকান সেরামপুরের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তিনি বলেন, আড্ডা ও পাড়া সংস্কৃতি ছত্র এলাকায় বেশ প্রাসঙ্গিক। ছত্র পাড়ায় নরেশ সোমের চায়ের দোকান আড্ডা সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রতিদিন মানুষ জমায়েত হন এবং একে অপরের সঙ্গে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।