মত-মতান্তর
শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম: এখন কী করণীয়?
আসিফ বায়েজিদ
(২ সপ্তাহ আগে) ২৭ আগস্ট ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭:৫৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৭ পূর্বাহ্ন
গত দেড় দশকের জুলুমশাহীর অবসান ঘটিয়ে গেল ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতা যখন নিজের দেশ বুঝে নিলেন, আমাদের হাতে তখন বাকি রয়েছে অর্থনীতির ভগ্নাংশ, ঋণের বোঝা এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। আর বাকি রয়েছে স্বৈরাচারী সরকারযন্ত্র প্রণীত এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা যা জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থ। দুর্নীতি আর অনিয়মে ছেয়ে থাকা শিক্ষা ব্যবস্থা কেবলই হীরকরাজের গুণগান আর মিথ্যা সাফল্যগাথা গেয়ে গিয়েছে। তবে আমরা আশা হারাতে চাই না, অত্যন্ত বরেণ্য ব্যক্তিবর্গকে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পর্ষদে পেয়েছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার, তাই তাদের উপরই শিক্ষা নিয়ে এই জাতীয় আলোচনাটি পরিচালনার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়। জুলুমের শাসন যত ক্ষতিসাধন করেছে, আমরা সবাই মিলে খেটেখুটে সেগুলো ঠিকঠাক করে নিতে পারবো নিশ্চয়ই। আমাদের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম সংস্কারের উপায় নিয়ে সর্বস্তরে কথা বলা প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে নবীন পেশাদারের দৃষ্টিকোণ থেকেই আমার আজকের আলাপ।
অজস্র সমস্যার সমালোচনার মাঝে বাস্তবতা এই যে, নবনির্মিত শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং মূল্যায়নব্যবস্থা অকস্মাৎ বাতিল করে ফেলা বা অতর্কিতে পুরনো শিক্ষাক্রমে ফেরত যাওয়াও একই বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ শিক্ষা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সূক্ষ্ম একটি ক্ষেত্র। এটিকে যত্ন, সতর্কতা ও সুবিবেচনার সঙ্গে পরিচালনা করা কাম্য। পর পর কয়েকটি বৃহৎ পরিবর্তন শিক্ষার্থী সহ অন্যান্য অংশীজনদেরও আরেকটি প্রচণ্ড ধাক্কার মাঝে নিয়ে ফেলবে। এবং একই সঙ্গে এ-ও স্বতঃসিদ্ধ যে শিক্ষাক্রমের কাজ সামনে অগ্রসর হওয়া, পেছনে ফেরত যাওয়া নয়। তাই বাতিল বা স্থগিত না করে বিচক্ষণতার সঙ্গে কিছু তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, যার মধ্যদিয়ে ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। সাবধানী এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের বাস্তবিক বিকাশের সহায়ক শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি প্রণয়ন করার রাস্তা প্রশস্ত হয় এবং শিক্ষা নিয়ে সরকারি উদ্যোগের উপর জনগণের আস্থা ফেরত আসে।
এই মুহূর্তে করণীয়
তাৎক্ষণিক ক্ষতিটুকু মোকাবিলা করার জন্য সর্বপ্রথম শিক্ষকবৃন্দের মতামত এবং পরামর্শ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখে শিক্ষকবৃন্দের কী ভাবছেন তার উপর একটি জরিপ করা জরুরি। এই কাজটুকু পদ্ধতিগতভাবে করা জরুরি; কারণ বিচ্ছিন্ন ধরনের তথ্য এবং মতামতের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে গিয়ে অন্য ধরনের বিপর্যয় টেনে আনতে পারে। জরিপটি থেকে বিষয় এবং শ্রেণিভিত্তিক তথ্য উঠে আসবে যা থেকে আমরা বুঝতে পারবো- পাঠ্যপুস্তকের কোন কোন অংশ অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর, অসংলগ্ন, অসঙ্গতিসম্পন্ন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থাপনার অযোগ্য। যেমন, ট্রান্সজেন্ডার এবং তৃতীয় লিঙ্গের মাঝে মৌলিক পার্থক্য, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে রন্ধনশিল্পের বিকাশ করতে চাওয়া ইত্যাদি বিষয়সমূহ জাতীয় পর্যায়ে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণিতে বিভিন্ন সংখ্যাপদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যে কেবল বাইনারি পদ্ধতির উপরে আলোকপাত করে উপস্থাপন করা হয়। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের থেকে স্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন কোন অংশগুলো উপকারী এবং কোন অংশগুলো পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা উচিত বলে তারা মনে করছেন। শিক্ষকদের মতামত সংগ্রহের জন্য একটি গবেষণা টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে যারা জরিপটি উন্নয়ন থেকে শুরু করে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন ও সুপারিশ উপস্থাপন করবেন। তাদের উপস্থাপিত প্রতিবেদনের প্রধানতম আকর্ষণ থাকবে- স্বল্পতম সময়ের মাঝে শিক্ষকদের কী সাহায্য সরবরাহ করা যায়।
প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চিহ্নিত অস্পষ্ট অংশসমূহের উপর কার্যকরী ভিডিও কন্টেন্ট নির্মিত হতে পারে। বাংলাদেশের তরুণদের পরিচালিত প্রথম সারির ই-লার্নিং প্ল্যাটফরমগুলোর উপর এই দায়িত্ব দিয়ে দিলে অনধিক দুই মাসের মাঝে তারা সম্পূরক ভিডিও কন্টেন্ট নির্মাণ করে দিতে পারেন। তাদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞগণ সংযুক্ত থাকতে পারেন। সরকারি উদ্যোগে শিক্ষকদের জন্য ই-লার্নিং প্ল্যাটফরমগুলো অবারিত করে দেয়া যেতে পারে।
স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ
অধিক কালক্ষেপণ না করে প্রথমেই একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘ সময় কেটে গেছে বাংলাদেশের শিক্ষা কোনো ঋদ্ধ কমিশনের তত্ত্বাবধানে নেই। দেশে-বিদেশে কর্মরত বিজ্ঞানী, চিন্তক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অভিভাবক, ব্যবসায় এবং সেবা খাতের নেতৃবৃন্দ, চাকরিদাতাদের সম্মিলনে কমিশনটি গঠন করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ের থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হবে- সদস্যদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং দূরদর্শিতা। কমিশনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বও কাঙ্ক্ষিত হবে।
এই কমিশনের প্রথম কাজ হবে একটি শক্তিশালী গবেষক দলের সাহায্যে পূর্ববর্তী শিক্ষানীতি এবং তার বাস্তবায়নের উপর একটি গভীর এবং স্বচ্ছ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। আমাদের শিক্ষা বর্তমানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে বিষয়ে প্রতিবেদনটি সংখ্যাবাচক এবং গুণগত ধারণা দেবে। আমরা জানতে পারবো কোথায় অসঙ্গতি, কী কারণে শিক্ষায় সরকারি উদ্যোগ বিফলে যায়। ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করে, নির্ণয় করে, তবেই নির্ধারণ করা সম্ভব হবে- আমরা কোথায় যেতে চাই।
কমিশনের গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা শিক্ষার জাতীয় দর্শন এবং জাতীয় লক্ষ্য নিরূপণ করতে পারবো। এক্ষেত্রে যদি একটি ‘টপ-ডাউন’ পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় তবে বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনমুখী ধাপগুলো নির্ণয় করা সহজ হবে। সামগ্রিক বিচারে এই শিক্ষা কমিশন আন্তরিক গবেষণালব্ধ ফলের উপর নির্ভর করে একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। শিক্ষানীতিটি একটি তুলনারহিত নীতি না হয়ে যুব, কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, অর্থনীতি, কৃষি, ক্রীড়া, পররাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট সকল নীতির সঙ্গে সমন্বিত হবে। নব্যপ্রণীত শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য হবে প্রতিনিধিত্বকারী তথ্য ও উপাত্তনির্ভর, যেন আমরা সম্মত হতে পারি যে, তা গণমানুষের কণ্ঠ, দাবি এবং আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করে। শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নের স্বচ্ছ পরিকল্পনা এবং অর্জন সূচকসমূহ চিহ্নিত এবং প্রকাশিত থাকা বাধ্যতামূলক।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সুপারিশ
বাংলাদেশ এমন একটি সম্ভাবনাময় সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যখন দেশের তরুণ-যুবা জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে। অর্থনীতিবিদরা এই অবস্থাকে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলে আখ্যায়িত করতে পছন্দ করেন। কারণ তরুণের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। কিন্তু তাদের উদ্যম নির্ভর করবে দেশ তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, মানসিকতা এবং যোগ্যতা দিয়ে তাদের কতোটা প্রস্তুত করে তুলতে পারছে। সে জন্যই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তরুণদের অংশ হিসেবেই নিচের দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবনাগুলো দিচ্ছি।
১. বাজেট: একটি ভীষণ উদ্বেগের জায়গা হলো শিক্ষাখাতে বাজেট। পদ্ধতিগত দীর্ঘসূত্রতা এবং যৎসামান্য অর্থায়ন দিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনে পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটানো পরিহাসসম। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাক্রম তুলে এনে বাংলাদেশে প্রতিস্থাপনের চেয়ে বরং দুটি পাঠ্যক্রমের পর্যালোচনা করা বেশি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এই বিষয়টিও দেখা জরুরি যে যেসব দেশ শিক্ষায় ভালো করছে, তারা কী পদ্ধতিতে নীতি প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করছে এবং তার জন্য কতোখানি এবং কী কী ব্যয় করছে। জাতীয় আয়ের অনধিক ২ শতাংশের চর্চা থেকে বের হয়ে এসে অন্তত ৬.৫%-এ উন্নীত করা গেলে এবং দুর্নীতি ও অপচয় পাশ কাটানো গেলে শিক্ষাখাতে স্বল্প সময়ের মাঝেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে অনুমান করা যায়।
২. বিভাগ নির্বাচনে নমনীয়তা: উচ্চ মাধ্যমিক, অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষায় বিজ্ঞান, বাণিজ্য, এবং মানবিক বিভাগগুলোর বিভাজন না রেখে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় পছন্দ করার সুযোগ দেয়াই শ্রেয়। বাংলাদেশের প্রথাগত বিভাগভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বিকাশের সুযোগকে সীমিত করে। অনুকরণ করার উদ্দেশ্যে নয়, তবে পিয়ারসন এডএক্সেল, ক্যামব্রিজ বা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাচেলরেট শিক্ষাক্রম লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ও লেভেল বা নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, হিসাববিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো একত্রে পড়ার সুযোগ পায়। এই নমনীয়তার ফলে, শিক্ষার্থীরা পরবর্তী পর্যায়ে, যেমন এ-লেভেল, দ্বাদশ শ্রেণি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় বেছে নেয়ার মাধ্যমে তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারে, যা ভবিষ্যতে তাদের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মেধার স্বাক্ষর রাখলেও, এই বিভাগভিত্তিক বিভাজন তাদের অনেকের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বিভাজন না থাকলে, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের প্রশাসনিক জটিলতাও কমে আসবে। একইসঙ্গে, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সমতার পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে তারা তাদের আগ্রহ ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিজেদের শিক্ষার দিক নির্ধারণ করতে পারবে। দীর্ঘমেয়াদে, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভাজন না রাখা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করে একটি গঠনমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
৩. বাধ্যতামূলক বিষয়: ভাষা, গণিত এবং বিজ্ঞান শিক্ষা দ্বাদশ বর্ষ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা জাতীয় উন্নয়নে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির লক্ষ্যে লিবারেল আর্টস বিষয়ে পড়ার ঝোঁক লক্ষণীয়। সামাজিক বিজ্ঞান এবং কলা পাঠ একটি জাতির জন্য জরুরি, তবে অদূর ভবিষ্যতে আমরা জাতীয় আগ্রহ গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে বাঁক পরিবর্তন করতে না পারলে উদ্ভাবন, বিশ্লেষণ এবং উদ্যোগ গ্রহণ বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। অথবা শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়ে অনানুষ্ঠানিক এবং স্বাধীনভাবে শিখতে আরম্ভ করবে।
৪. গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত: ভবিষ্যতের শিক্ষা উন্নয়নের ভিত্তি হওয়া উচিত গবেষণালব্ধ তথ্য ও উপাত্ত। আকস্মিক ও অপরিকল্পিত পরিবর্তনগুলো শিক্ষার্থীদের জ্ঞানগত দক্ষতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করেছে। তথ্য উদ্ঘাটনে আমাদের জাতিগত অনীহা থাকায়, কোনো নীতিমালা তৈরি হলেও তা বাস্তবায়নকারীদের যথাযথভাবে বুঝানো হয় না, ফলে নীতির উদ্দেশ্য থেকে বাস্তবায়ন অনেকটা সরে যায়। উদাহরণস্বরূপ, নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও এর যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি এবং সেই সঙ্গে শিক্ষানীতি ২০১০-এর কোনো সংযোগও স্থাপিত হয়নি। এই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তগুলো গবেষণালব্ধ ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক না হওয়ায়, শিক্ষাক্রমের উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ। সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে উন্নয়ন না করলে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তও একই রকম ব্যর্থ হবে।
৫. বিরাজনীতিকরণ: জাতি গঠনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরাজনীতিকরণ করে পুনর্গঠন প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, এনসিটিবি বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে কাজের জন্য যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নয়, বরং ব্যক্তিগত সুপারিশ ও রাজনৈতিক পরিচয়ই প্রধান মানদণ্ড ছিল। এনসিটিবি উন্নয়ন ও বেসরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞদের কাজে নিয়োগে অনীহা দেখিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের প্রাপ্য সম্মানী ও অর্থ বরাদ্দ ছাড়াই কাজ করানোর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত। ফলে, জ্যেষ্ঠ সদস্যরা প্রায় নির্লিপ্ত থেকে অনভিজ্ঞ কনিষ্ঠদের ওপর কাজের ভার চাপায়, যা শিক্ষাক্রমের গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৬. শিক্ষক উন্নয়ন: শিক্ষকদের জন্য পরিকল্পিত, উচ্চমানসম্পন্ন এবং ক্রমাগত পেশাগত উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে এবং উন্নয়নের সাফল্যের সঙ্গে প্রেষণার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতিফলন শিক্ষকবৃন্দের বেতন কাঠামোতেও পড়তে হবে। এতে বর্তমান শিক্ষকবৃন্দ স্বাচ্ছন্দ্যে নিজ পেশায় মনোনিবেশ করতে পারবেন, ভবিষ্যতে তরুণেরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে শিক্ষকতা পেশায়।
৭. মূল্যায়নে পার্সেন্টাইল র্যাংক: যথাযোগ্য মূল্যায়নের উপর শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ধাপে উত্তরণ এবং সাফল্য নির্ভর করে। পরীক্ষার প্রতিযোগিতাজাত ভীতির কারণ ও তার সমাধান করা গবেষণার বিষয় বটে, কিন্তু পরীক্ষা দূর করে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক মূল্যায়ন প্রবর্তন করা তার সমাধান নয়। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অংশীজনরা এর উদ্দেশ্য, উপযোগিতা ও সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ এটি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বোঝাপড়ার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া, নতুন গ্রেডিং পদ্ধতিও সমালোচিত হয়েছে, যা পূর্বের লেটার গ্রেডগুলোর নতুন নামকরণ মাত্র। এই পদ্ধতিতে অংশীজনদের আস্থা নেই, এবং ব্যক্তিনির্ভর মূল্যায়নে দুর্নীতি এড়ানো সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার পূর্বের লেটার গ্রেড পদ্ধতিতেও শিক্ষার্থীদের মাঝে মুখস্থ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং ভীতির উদাহরণ অহরহ। তাই সেটিতে ফেরত যাওয়াও সমীচীন হবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বিশ্বব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত পার্সেন্টাইল র্যাংক পদ্ধতি বাংলাদেশের পটভূমিতে ব্যবহারযোগ্য কিনা, তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
৮. তরুণদের কর্মসংস্থান: উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব বাংলাদেশে একটি ক্রমবর্ধমান সংকট, এবং এর আশু সমাধান বড় কঠিন। অবিলম্বে এর একটি সমাধান হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োগ করে জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে সুযোগ করে দেয়া। ছয় মাসের প্রাক-পরিষেবা প্রশিক্ষণের পর এই তরুণ গ্রাজুয়েটরা শিক্ষক বা সহকারী শিক্ষক পদে কাজ করতে পারেন। ইতিমধ্যে টিউশনে সিদ্ধহস্ত তরুণেরা তাদের অভিজ্ঞতা এবং উদ্যম ব্যবহার করে দেশসেবায় অংশ নিতে পারেন, এবং একই সঙ্গে বেকারত্বের হাত থেকে অবিলম্বে মুক্ত হতে পারেন।
শেষ কথা
শিক্ষা আমাদের বড় অবহেলিত খাত। জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ২০২২-এর ফলাফল বলে আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়া প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী সত্যিকার অর্থে পড়ে বুঝতে, লিখতে এবং মৌলিক যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে সক্ষম নয়। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন এই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, গবেষক, ব্যবসায়ী, এবং সামাজিক উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে। যতই ঘাটতি থাকুক, আমি আশাবাদী যে, আমরা ছেলেমেয়েদের পেছনে সঠিক বিনিয়োগ করে গড়েপিঠে নিতে পারবো, যেন সামনের দিনগুলো তাদের জন্য সুগম এবং প্রশস্ত হয়। আন্তরিকতা এবং গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রাপ্য এক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে নিবো।
লেখক: শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম গবেষক, যুক্তরাজ্য। [email protected]