বাংলারজমিন
আমতলী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের অপসারণ দাবি
স্টাফ রিপোর্টার
৬ জুলাই ২০২৫, রবিবারবাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী আমতলী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুহা. বায়েজিদ হোসেনের নানা অনিয়ম, দংর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আমতলী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ বোর্ড ম্যানেজ করে অধ্যক্ষ হন। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বাগেরহাট জেলা প্রশাসক ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরজমিন অনুসন্ধানে অধ্যক্ষ মাওলানা মুহা. বায়েজিদ হোসেনের বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপ, পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক, স্টাফ, অভিভাবকদেরকে দমন-পীড়ন সহ নানান অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই তিনি মাদরাসার ঐতিহ্যবাহী লিল্লাহ বোর্ডিং আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেন। ফলে বিপাকে পড়েন আমতলী মাদরাসায় অসহায়, দরিদ্র শিক্ষার্থীরা। শতবছর ধরে চলে আসা লিল্লাহ বোর্ডিং বন্ধ হলেও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের জন্য দোকান ভাড়া, স’মিল, জমির ফসল এবং মানুষের দান-খয়রাত ও যাকাতের টাকার আয়-ব্যায়ের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। চলতি ২০২৫ সালের কুরবানিতে অধ্যক্ষ মুহা. বায়েজিদ হোসেন ১১৪টি গরুর চামড়া সংগ্রহ করলেও রহস্যজনক কারণে চামড়ায় লবণ রেখে গত ১৯ দিন যাবৎ ফেলে রেখেছে।
লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের জন্য আসা লক্ষ লক্ষ টাকা কোথায় যায়? অধ্যক্ষ এবং তার পোষ্য লোকজন ছাড়া এব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। তিনি অধ্যক্ষের জন্য নির্মিত বাসবভনে থাকলেও নিয়মানুযায়ী বাসভবনের ভাড়া দিচ্ছেন না। উপরন্তু নিজের ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট বিলও তিনি মাদ্রাসা থেকে পরিশোধ করেন।
১৯২৩ সালে আমতলী মরহুম পীর সাহেব আল্লামা আব্দুল লতীফ (রাহি.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির শতবর্ষ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ম্যানেজিং কমিটির রেজুলেশন ছাড়াই অধ্যক্ষ তার অনুসারীদের দিয়ে পকেট কমিটির মাধ্যমে একটি ব্যাংক একাউন্ট খোলেন। ওই একাউন্ট ব্যবহার করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে মাদ্রাসার শতবর্ষ উৎসব পালনের জন্য চাঁদা আদায় শুরু করেন। এছাড়া সন্ন্যাসী বাজার শাখা অগ্রণী ব্যাংকে মাদ্রাসার একটি ব্যাংক একাউন্ট (হিসাব নং ২২০০) থেকে গভর্নিং বডির অনুমোদন ছাড়াই টাকা উত্তোলন করে নিজের মর্জি মতো খরচ করে চলছেন। এ ব্যাপারটি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও এডিসি জেনারেল অবগত হয়ে অভিযোগ আমলে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।
নিজ জেলা নড়াইলে ওলামা লীগের সক্রিয় নেতা মুহা. বায়েজিদ হোসেন বিগত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সময়ে স্থানীয় এমপি এডভোকেট আমিরুল আলম মিলনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারির ভূয়া নির্বাচনের এমপি, সাবেক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগের নির্বাচনী কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি নড়াইলের বিনাভোটের এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং তার পিতা গোলাম মর্তুজার লোক হিসেবে সব জায়গায় পরিচয় দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতেন।
অধ্যক্ষ মুহা. বায়েজিদ হোসেন মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে আওয়ামী সরকার দলীয় লোক ছাড়া কাউকে সহ্য করতেন না। আমতলী মাদ্রাসায় বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেন। উপরন্তু আমতলী মাদ্রাসাকে আওয়ামীকরণের অংশ হিসেবে বিগত গভর্নিং বডিতে মাদ্রাসা পার্শ¦বর্তী দু’জন আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন খান জাকির এবং মাস্টার সাঈদুর রহমানকে বিদ্যুৎসাহী সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত করেন। ঐতিহ্যবাহী আমতলী মাদ্রাসায় এমন দলীয়করণ এর আগে কখনও হয়নি। ওলামা লীগের সাইন বোর্ড ব্যবহার করে তিনি হিফজখানা, লিল্লাহ বোডিং, ইয়াতীমখানা সহ মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে অবিস্থত বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে নিজের পছন্দ মতো লোকদের বসান। এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনি শতভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছেন। ফলে অসহায়, দরিদ্র এবং ইয়াতিম শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করতে পারছে না।
সম্প্রতি আমতলী তাহফিজুল কুরআন মাদরাসা তথা হিফজখানার নজিরবিহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম নিয়ে অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজন সোচ্চার হলে প্রতিষ্ঠাতার নামে গঠিত আল্লামা আব্দুল লতীফ (রাহি.) ট্রাস্টের উদ্যোগে একটি সাধারণসভা আয়োজন করা হয়। ওই সাধারণসভায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে হিফজখানার জন্য একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। নবনির্বাচিত কমিটি গত ২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে হিফজখানা পরিদর্শনে গেলে অধ্যক্ষ পুরো ভবনটিতে তালা লাগিয়ে দেয়। এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করছিল।
স্থানীয় জনতার চাপের মুখে অধ্যক্ষ মুহা. বায়েজিদ হোসেন তালা খুলে দিলেও আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা তার পালিত গুণ্ডা বাহিনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয়দের উপর হামলা চালায়। অধ্যক্ষের নির্দেশে দ্বিতীয় পিরিয়ডের সময় ডাবল ঘন্টা দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে মাঠে এনে জড়ো করে। তারা উত্তেজনাকর স্লোগান দিয়ে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের সদস্যদের ওপর উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা যেন হামলা করে সেজন্য উস্কানিমূলক স্লোগান দিতে থাকে। মুহা. বায়েজিদ হোসেনের নির্দেশে ছাত্ররা হিফজখানা ভবনে হামলার জন্য ধাওয়া করলে এসময় শিক্ষকদের একাংশ, স্থানীয় জনগণ এবং পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে বড় ধরনের সহিংসতা এবং রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়।
এ ঘটনায় মাদ্রাসার অভিবাভক ও স্থানীয়রা হতবাক হয়ে পড়ে। শান্তিপ্রিয় গ্রামবাসী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এরকম সন্ত্রাস এর আগে কখনো দেখেনি। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী মাদ্রাসা অধ্যক্ষের দুর্নীতি ও অনিয়মের সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে অপসারণ সহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। গত ২৪শে মে মাসে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোদ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমতলী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার কামিল প্রথম বর্ষের পরীক্ষা কার্যক্রম তদন্তের জন্য সরজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি পরীক্ষার্থীদের নিকট থেকে প্রায় এক বস্তা পরিমাণ নকল এবং বই উদ্ধার করেন। পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুহা. বায়েজিদ হোসেন প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পরে কেন্দ্রে আসেন এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন। বিধি অনুসারে কেন্দ্র সচিবকে থানা থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে হয় এবং পরীক্ষা কমিটির সামনে নির্দিষ্ট সময়ে প্রশ্নপত্র সম্বলিত খামের সিলগালা খুলতে হয়। আমতলী মাদ্রাসার কামিল পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব এসবের তোয়াক্কা করেন না। তিনি নিজের মেজাজ-মর্জি মতো পরীক্ষা কেন্দ্রে আসেন। কেন্দ্র সচিব হিসেবে তিনি কেন্দ্র কমিটিতে মাদ্রাসার জুনিয়র শিক্ষক আব্দুল জলিল মোল্লাকে পরীক্ষা কমিটিতে অন্তুর্ভুক্ত করেন। অথচ আব্দুল জলিল মোল্লার স্ত্রী মারুফা আক্তার আমতলী মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে কামিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, যা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বে অবহেলা এবং অনিয়ম এবং দুর্নীতির ব্যাপারে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং ক্ষুব্ধ এলাকাকবাসী কেন্দ্র সচিব এবং মাদ্রাাসার অধ্যক্ষকে বিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি তথা আজীবনের জন্য পরীক্ষার যাবতীয় কার্যক্রম থেকে বহিস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মুহা. বায়েজিদ হোসেন বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে যোগদানের পর আমার নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়েছে। অচিরেই এসব মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
আমতলী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বাগেরহাট জেলার এডিসি (সার্বিক) আরিফুল ইসলাম বলেন, অধ্যক্ষের দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে একাধিক লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দু’টি অভিযোগ মোড়েলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার তদন্ত করছেন। বিধি অনুসারে অধ্যক্ষের ব্যাপারে আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।