ঢাকা, ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

বাংলারজমিন

‘সুপার ভিলেজ’ আব্দুল্লাহপুর

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে
৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার
mzamin

কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রাম আব্দুল্লাহপুর। অথচ প্রত্যন্ত এই গ্রামটিই হয়ে উঠেছে এক ‘সুপার ভিলেজ’। এ গ্রামের সাত হাজারের মতো মানুষ প্রবাসী। জেলার সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে প্রবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামটিতে। শুধু জেলায়ই নয়, সারা দেশের গ্রামপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড গড়েছে গ্রামটি। এই গ্রামের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রান্তিক পর্যায়ে আব্দুল্লাহপুর আউলেট শাখা বিভিন্ন সময়ে সারা দেশে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপজেলার ৭ নম্বর খয়েরপুর-আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের ৫, ৬, ৭ ও ৮ এই চারটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত আব্দুল্লাহপুর গ্রামের জনংসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে ভোটার সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। এখানকার মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটারের সিংহভাগই প্রবাসী। এ ছাড়া ভোটার তালিকার বাইরেও অনেক প্রবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে এ গ্রামের অন্তত ৪ হাজার প্রবাসী রয়েছেন। এ ছাড়া, শুধু ইতালিতেই রয়েছেন আড়াই থেকে তিন হাজারের মতো প্রবাসী। বৈধ-অবৈধ উভয় পন্থায় ইতালি প্রবেশের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এই গ্রামের বাসিন্দারা। অনেকে সরকারি চাকরি ছেড়েও পাড়ি জমিয়েছেন ইতালিতে। ইতালির ভেনিসে বিপুল ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন আফাই আলী নামে আব্দুল্লাহপুরের এক যুবক। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এক বা একাধিক প্রবাসী রয়েছেন। আবার এমন অনেক পরিবার রয়েছে যাদের সকল পুরুষ সদস্যই প্রবাসী। রেমিট্যান্স আর কৃষি অর্থনীতি- এই দুইয়ে মিলে গ্রামটি এখন ধনাঢ্যদের গ্রামে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে গ্রামটির জীবনযাত্রার মানেও। আব্দুল্লাহপুর গ্রামে চলছে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণের প্রতিযোগিতা। প্রান্তিক এই গ্রামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছেন অনেকে। যেগুলোর বেশির ভাগই থাকে ফাঁকা। এই এলাকার যুবকদের বয়স ১৮ পেরোলেই পাড়ি জমান প্রবাসে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। সেখানে গেলে ছেলেদের উপস্থিতি খুব একটা চোখে পড়ে না। স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানকার ছেলেদের মধ্যে প্রবাসের একটা প্রবণতা কাজ করে। তাই তারা শিক্ষার দিকে না ঝুঁকে অর্থ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন প্রবাসে। আব্দুল্লাহপুর ইদ্রিস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল কুদ্দুস, উত্তর আব্দুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মনির হোসেন, আব্দুল্লাহপুর বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোস্তফা কামাল প্রমুখসহ শিক্ষাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্থানীয় তরুণ-যুবকদের মধ্যে প্রবাসযাত্রার এ প্রবণতার কথা জানান। তবে, এ গ্রামের অনেকেই আবার শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বড় বড় চাকরিসহ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। এ সংখ্যাটাও বেশ ঈর্ষণীয়। প্রবাসী জিয়াউর রহমান জনি ও তার স্ত্রী সাবেক ইউপি সদস্য জরিনা আক্তার জানান, তাদের তিন সন্তান ইতালি ও ফ্রান্স প্রবাসী। জিয়াউর রহমান নিজেও দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন।
এদিকে স্থানীয় অনেকেই জানিয়েছেন, আব্দুল্লাহপুর গ্রামটি জেলার মধ্যে একটি অনন্য গ্রাম। তবে, বিভিন্ন সময়ে গ্রামে তুচ্ছ কারণে হানাহানি, মারামারি ও সংঘর্ষ হয়। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। অনেক সময় প্রবাসের কোনো ঘটনা, ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্যের প্রভাবও গ্রামটিতে পড়ে। প্রবাসের ঘটনা, ঝগড়া ও মনোমালিন্যের জেরেও গ্রামটিতে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। এর বাইরে সার্বিকভাবে হাওরের বুকে গ্রামটি ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খয়েরপুর-আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনিও দীর্ঘদিন ইতালিতে ছিলেন। এখন তার ছেলেসহ বংশের ৩৬ জন ইতালিতে রয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান এ গ্রামের মানুষদের প্রবাসী হওয়ার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে জানান, আশির দশকে পোর্ট এন্ট্রি ভিসায় আব্দুল্লাহপুর গ্রামের ৩০/৩৫ জন লোক জার্মান গিয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ কিছু টাকা-পয়সার মালিক হয়ে দেশে চলে আসে, আর কিছু লোক থেকে যায়। পরে ১৯৯০ সালে তারা চলে যায় ইতালিতে। সেখানে কিছুদিন থেকে যাবতীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে ইতালির বৈধতা লাভ করে। পরে আবারো সুযোগ পেয়ে কিছু লোক রাশিয়া হয়ে ইতালিতে প্রবেশ করে। এর পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে ইতালিতে স্পন্সর ভিসা চালু করে শ্রমিক নেয়া শুরু করে। তখন আব্দুল্লাহপুর গ্রামের অনেকেই স্পন্সর জমা দিলেও ভিসা পান কেবল তিনিই। পরে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ইতালি পাড়ি জমান। ২০০২ সালে ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে আগ্রহী সকলের ভিসা অনুমোদন করে দিলে আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বিশাল একটা অংশ ইতালি প্রবেশের সুযোগ পান। এর কিছুদিন পরেই বাঙালিদের জন্য ইতালি প্রবেশের পথ খানিকটা কঠিন হয়ে যায়। পরে চালু হয় কৃষি ভিসা। কৃষি ভিসায়ও আব্দুল্লাহপুরের একটা জনবল ইতালি প্রবেশের সুযোগ পায়। এরপর থেকে ইতালিতে বসবাসরত অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের নিতে থাকেন। সর্বশেষ বিগত কয়েক বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ জনের মতো ইতালিতে প্রবেশ করেছেন লিবিয়া হয়ে অবৈধ পথে। এখন ইতালিতে শুধু এই গ্রামেরই ২৫০০ থেকে ৩ হাজার লোক কাজ করছেন। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আব্দুল্লাহপুর গ্রামের চার হাজারের মতো লোক কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে আব্দুল্লাহপুর গ্রামটিকে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে ডাকা হয়। এই গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার টাকাও প্রবাসীরাই দিয়ে থাকেন, অন্য কোথাও হাত পাতার প্রয়োজন পড়ে না। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের এই গ্রামটিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতির দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি।
এদিকে, আব্দুল্লাহপুর গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে জানা গেছে, ১৮১৯ সালে নদীগর্ভে বিলীন হওয়া আনোয়ারপুর গ্রামের আনুমানিক ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে জনবসতি গড়ে তোলার জন্য গভীর জঙ্গল সাফ করান তৎকালীন জমিদার আব্দুর রশিদ চৌধুরী। তিনি সেখানে বসবাসের জন্য স্থায়ীভাবে তালুক প্রদান করেন। জমিদার আব্দুর রশিদ চৌধুরীর পিতা আব্দুল্লাহ এর নামানুসারে এই জায়গার নামকরণ করা হয় ‘আব্দুল্লাহপুর’।
 

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

দেনমোহর কমাতে অভিনব কৌশল/ তালাকের পর আবার বিয়ে, কিছুই জানে না গৃহবধূ

১০

মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা/ মোবাইল চোরকে সহযোগিতা করাই কাল হলো

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status