দেশ বিদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে ব্যবসায়ীরা হতাশ, ক্ষতি পোষাতে পথরেখা চান
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১০ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবারবাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারকরা। ১লা আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হবে। এই সময়ের মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে বাড়তি শুল্ক গুনতে হবে বাংলাদেশকে। বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি এবং লবিস্ট নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ক্ষতি পোষাতে পথরেখাও চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাণিজ্য উপদেষ্টা এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রথম দফায় পাওয়া তিন মাসে সুবিধা করতে পারেনি সরকার। এখন দ্বিতীয় দফায় ডনাল্ড ট্রাম্প যে আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন সেটিকে এবার ভালোভাবে কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতা ও বিশ্লেষকরা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর লক্ষ্যে সরকারি খাতে খাদ্যশস্য কেনা এবং উড়োজাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রাধান্য দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন আরেকটি প্রস্তাবের খসড়া দিয়েছে। সেখানে শুল্কারোপ নিয়ে আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় দেশটির সাউথ এশিয়া ন্যাশন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারকে দায়িত্ব দিয়েছে ইউএসটিআর (অফিস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ)।
শুল্কহার কতো: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে বাংলাদেশের পণ্যে নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে প্রকৃত শুল্ক কতো হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ যে ধরনের পণ্য রপ্তানি করে থাকে, সেসব পণ্যে বর্তমানে গড়ে ১৬ শতাংশ শুল্ক ধার্য রয়েছে। গত ২রা এপ্রিলের ঘোষণায় সব দেশের জন্য ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়, যা ৫ই এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কহার দাঁড়ায় ২৬ শতাংশে। নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৬১ শতাংশে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে লেখা চিঠিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, নতুন শুল্ক প্রযোজ্য হবে খাতভিত্তিক বিদ্যমান শুল্কের অতিরিক্ত। এর অর্থ ৬১ শতাংশই হতে পারে শুল্ক।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, নতুন করে যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়, তাহলে গত ৫ই এপ্রিল কার্যকর হওয়া ১০ শতাংশ রহিত হবে। তাতে শুল্ক দাঁড়াবে ৫১ শতাংশ। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, মোট শুল্কহার কতো দাঁড়াবে, সে বিষয়ে তারা স্পষ্ট কিছু বলতে পারছেন না।
শুল্ক কমানো না হলে চাপে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। একক দেশ হিসেবে পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন সিদ্ধান্তে প্রতিযোগী ভারত, পাকিস্তানের শুল্কারোপ বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক কম হয়েছে। তবে নেগোসিয়েশনে দুর্বলতা ছিল বলে মনে করেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। যদি সাকুল্যে ৩৫ শতাংশ হতো, তাহলে ভালো নেগোসিয়েশন হয়েছে বলে ধরা যেতো। কিন্তু সেটা তো হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, আমাদের কিন্তু সমঝোতার ক্ষেত্রে বড় মাত্রায় দুর্বলতা আছে। আমাদের তো আসলে কোনো এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) নাই। আমাদের কোনো বাণিজ্য চুক্তি নাই কোনো দেশের সঙ্গে। তার মানে আমরা তো ওই সমঝোতার মধ্যেই কোনো সময় ছিলাম না। এটা আমাদের একটা দুর্বলতা। নিবিড় আলোচনা হতে পারতো যা হয়নি বলে তিনি মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি-আমদানি: এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার প্রায় ৮.৭ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে ২০ শতাংশ তৈরি পোশাক। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় আরও রয়েছে জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী, ওষুধ ও বিভিন্ন কৃষিপণ্য। এ রপ্তানির বিপরীতে দেশটি থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পণ্য। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ হাজার ৯২৭ ধরনের পণ্য আমদানি করেছে, যার আর্থিক মূল্য ৩৪ হাজার ২৮ কোটি টাকা বা ২৭৮ কোটি ৯২ লাখ ডলার। এর মধ্যে ১০ পণ্যের আমদানি মূল্যই হচ্ছে ২০৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে জাহাজের স্ক্র্যাপ, সয়াবিন বীজ, তুলা, এলপি গ্যাস, এয়ারক্রাফটের যন্ত্রাংশ ইত্যাদি।
তিন মাসে যা হলো: গত ২রা এপ্রিল এক প্রকার একতরফা বাণিজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন ট্রাম্প। বাংলাদেশও বড় ধাক্কা খায়। তখন প্রথমে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে নিজেই কথা বলবেন; পরে চিঠি লিখে তিন মাস সময় চাইলে তা দেয়া হয় বাংলাদেশকে। উচ্চ শুল্কের এই হার কমাতে তখন বেশকিছু উদ্যোগ দেখা যায় বাংলাদেশের তরফে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং সংলাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয় বাজেটে। এরমধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। তবে তাতে কাজের কাজ হয়নি। কাগজে-কলমে থাকলেও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যে আমদানি বাড়াতে হবে তার বাস্তবিক প্রতিফলন দেখা যায়নি এই তিন মাসে। ইউনূসকে লেখা চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সম্পর্কটি সমকক্ষ হওয়া থেকে অনেক দূরে।
গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, আমরা আরও নেগোশিয়েট করবো। তার আশা দরকষাকষির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে সক্ষম হবে সরকার। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, পোশাক খাতের ২০ শতাংশ বিজনেস যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এরফলে আমরা ব্যাপক প্রতিযোগিতার মুখে পড়বো।
সূত্র মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২রা এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। সেই সময় বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। এর আগে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হতো। তিন মাসের জন্য স্থগিত থাকা সিদ্ধান্তের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গতকাল সোমবার ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে দেশটি।
বাংলাদেশের করণীয়: বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটা প্রতিনিধিদল এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তারা নতুন করে আলোচনায় বসবেন।
বিজেএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আমরা মনে করি যেহেতু এখন তিন সপ্তাহ সময় আছে, এ সময়ের জন্য ইউএস লবিস্ট নিয়োগ করতে পারি অতিরিক্ত। অর্থাৎ বাণিজ্য উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং তাদের সকল ‘এফোর্ট’-এর বাইরে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারি। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে রপ্তানি করে থাকে। কারণ, খুব শিগগিরই বিকল্প বাজার ধরা সম্ভব নয়। এ ছাড়া ভিয়েতনামের পণ্য বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ এগিয়ে থাকবে। সেটাকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় একক বাজার। শুরু থেকেই আমরা সরকারকে বলেছি যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করে। আমরাও নিজেদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তার প্রস্তুতি রেখেছি। আমাদের এখন দরকার সুনির্দিষ্ট পথরেখা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে এহসান শামীম বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেবে, ভারতের সঙ্গে কী শর্তে চুক্তি করবে এবং ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে কিনাÑ এই তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রপ্তানির গতিবিধি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির বিষয়ও চালিয়ে যেতে হবে।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শেষ পর্যন্ত বাড়তি যে পাল্টা শুল্ক প্রস্তাব করেছে, দরকষাকষির মাধ্যমে সেটি কমাতে হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে। যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসবে। সরকারের দিক থেকে কিছু শক্ত ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হলে এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব। প্রথমত, আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপকভাবে তুলা আমদানির উদ্যোগ নিতে পারি। পাশাপাশি এলএনজি, স্টিল মেটালসহ আরও বেশকিছু পণ্য আমদানি বাড়াতে পারি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এখনো আলোচনার মাধ্যমে এই হার আরও কমানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে আমার মনে হয়, কর কমানোর বিষয়ে আমাদের আলোচনার ধরন এবং দাবিগুলোর যৌক্তিক ভিত্তি তাদের প্রত্যাশার মতো সুনির্দিষ্ট ও সুসংগঠিত ছিল না। আমাদের প্রস্তুতিটা খুব একটা গোছালো ছিল না।