ঢাকা, ২৬ মে ২০২৫, সোমবার, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

বাংলারজমিন

তামাক চাষে কমছে জমির উর্বরতা, নিধন করা হচ্ছে বৃক্ষ

আলমগীর কবির, আলফাডাঙ্গা (ফরিদপুর) থেকে
২৫ মে ২০২৫, রবিবার

কম খরচে অধিক লাভের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকছে ফরিদপুরের  আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা ইউনিয়নের আড়পাড়া, কোনাগ্রাম, টোনাপাড়া, গোপালপুর ইউনিয়নের কুলধর, টগরবন্দ ইউনিয়নের মালা, টিটাসহ বেশ কিছু  এলাকার  কৃষকরা। এতে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস সহ ক্ষতিকর বিষ প্রয়োগে পরিবেশের ভারসাম্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।অন্যদিকে বন ও পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে দেদারসে জ্বলছে তামাকচুল্লি। ফলে সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের বৃক্ষনিধন এবং কৃষকের বাড়ির আঙিনার বনজ-ফলজ গাছ নিধন করে এসব চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া কৃষক পরিবারেও দিন দিন বাড়ছে স্বাস'্য ঝুঁকি।
জানা গেছে, কয়েকটি দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা স'ানীয় কৃষকদের তামাক চাষ সমপ্রসারণে উৎসাহিত করছে। বাণিজ্যিকভাবে চারটি জাতের তামাকের চাষ করা হয়। এগুলো হলো এফসিভি, মতিহার, জাতি ও বার্লী। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি বীজ, সার ও অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলছে। এ কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতা ও বিনামূল্যে বীজ, ঋণ, সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তার কারণে এ উপজেলায় তামাক চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।কৃষক আর্থিক সহ সব ধরনের সুবিধা  পেলেও তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তামাক চুল্লির জ্বালানি সরবরাহ করে না। ফলে তামাক চুল্লির জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে বনজ ও ফলজ সম্পদ ধংসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হচ্ছে চাষিদের।
সরজমিনে উপজেলার বানা ইউনিয়নের কোনাগ্রাম এলাকায় দেখা গেছে, চুল্লির অনেক দূর থেকে নাকে ভাসছে তামাক পাতা পোড়ানোর অম্লঘ্রাণ। তবে এ ঘ্রাণে কেউই আঁচ করতে পারছে না মানব শরীরের জন্য এটা কত ক্ষতিকর। আরেকটু সামনে এগোলেই চোখে পড়ে পাশাপাশি দু’টি তামাক চুল্লি। যেখানে দেদারসে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
সুধীজনেরা মনে করেছেন, কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, তামাক উৎপাদনের আগে কোম্পানিগুলোর দর নির্ধারণ, বিক্রির নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ দানে তামাক চাষ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। গত কয়েক বছর আগেও এ উপজেলাতে যেসব আবাদি জমিতে শীতকালীন মৌসুমে ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে  পাট,   ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ও আলুসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিলো এখন সেসব জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে।
তামাক চুল্লির মালিক ইদ্রিস শেখ বলেন, এবছর  প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে তামাকের চাষ করেছি। এরজন্য ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি থেকে চাষাবাদের জন্য দুই লক্ষ টাকা প্রণোদনা পেয়েছি। গত দুইমাস ধরে জমি থেকে তামাক পাতা সংগ্রহ করে দুইটি চুল্লি স'াপন করে পাতা পোড়ানো হচ্ছে। কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ইদ্রিস শেখ বলেন, তামাকের পাতা পোড়াতে লাকড়ি হিসেবে কাঠের পরিবর্তে কী ব্যবহার করব, সে বিষয়ে কোম্পানি থেকে কোনো দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তামাক চুল্লিতে জ্বালানি কাঠ ঠেলে দেয়ার কাজ করছেন সুফিয়া বেগম। তবে তার মুখে নেই মাস্ক বা মুখবন্ধের ব্যবস'া। তিনি জানান, ক্ষতি জেনেও বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয়। কারণ এখান থেকে যে আয় করি তা দিয়েই সংসার চালাতে হয়।
বানা ইউনিয়নের কোনাগ্রামের পাশেই আড়পাড়া (মাইজপাড়া) ও টোনাপাড়া এলাকায় রয়েছে আরও পাঁচটি চুল্লি। এছাড়া প্রায় সব ইউনিয়নের হালচিত্র এমনই। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত চলে তামাক পাতা সংগ্রহ ও শুকানোর কাজ। উপজেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক তামাক চুল্লিতে এখন পাতা শুকানোর কাজ চলছে। এসব চুল্লির আশেপাশেই রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সমাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বলছে তামাক চুল্লি, পুড়ছে কাঠ। এসব কাঠ আনা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চল এবং বাগান থেকে। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত এবং আশপাশের মানুষেরও চরম স্বাস'্য ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে।
বানা ইউনিয়নের কামাল হোসেন নামে এক বাসিন্দা বলেন, ভোরে ঘরের জানালা খুলতেই তামাক পাতা পোড়ানোর বিষাক্ত নিকোটিনের গ্যাস আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরটাকে বিষাক্ত করে দেয়। অথচ তখন প্রাকৃতিক বাতাস খুবই বিশুদ্ধ থাকার কথা। আগে পেতাম বিশুদ্ধ বাতাস আর এখন পাচ্ছি তামাকের বিষাক্ত গ্যাস। তামাকের জন্য গভীর রাতেও আমরা বিশুদ্ধ বাতাস পাচ্ছি না। পুরো এলাকায় বিশুদ্ধ বাতাসের সংকট দেখা দিয়েছে। বসতবাড়ি এলাকায় তামাকচুল্লি স'াপন বন্ধ করতে না পারলে আমরা ব্যাপকভাবে স্বাস'্যঝুঁকিতে পড়ব।
উপজেলা বন  কর্মকর্তা লিটন মিয়া  বলেন,তামাক চাষে একদিকে যেমন ফসলি জমি কমছে, অন্যদিকে তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য বনের কাঠ আহরণের হিড়িক পড়ছে। এতে দিন দিন  হুমকির  সম্মুখীন হচ্ছে   বন্যপ্রাণীরা। আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা বলেন, কৃষি জমিতে জনস্বাস'্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তামাক চাষ অত্যান্ত ক্ষতিকর। তবে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কৃষকদের বিনামূল্যে তামাকের বীজ, সারসহ ঋণও দেয়ায়  তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা । এ জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের বিভিন্নভাবে সচেতন করেও তামাকের চাষ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বাস'্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, তামাক চাষ ও সেবন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক পাতার বিড়ি, সিগারেট, গুল, খইনি ও জর্দাসহ নানান ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করায় হাসপাতাল গুলোতে দিন দিন শ্বাসকষ্ট, চর্ম, ও ক্যান্সারসহ নানা ধরণের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তামাক চাষে কৃষকদের পাশাপাশি স্বাস'্য ঝুঁকিতেও রয়েছেন সাধারণ মানুষ, পশু পাখি সহ প্রাকৃতিক পরিবেশের  ভারসাম্য।


আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল ইকবাল বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ-খবর নিয়ে এসব চুল্লির বিরুদ্ধে ব্যবস'া নেওয়া হবে।

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status