দেশ বিদেশ
জিনের বাদশার নামে অভিনব প্রতারণা ফাঁদ
স্টাফ রিপোর্টার
২৬ মে ২০২৫, সোমবারজিনের বাদশা, তান্ত্রিক, জৈনপুরী, মা ফাতেমার দরবারে সকল সমস্যার সমাধানের নামে প্রকাশ্যে ইউটিউব চ্যানেলে ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। এমনই এক চক্রের ফাঁদে সর্বস্ব হারিয়েছেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়ার গৃহবধূ রহিমা বেগম।
রহিমা বেগমের সৌদি প্রবাসী স্বামী ১৭ জন বাংলাদেশির ভিসার জন্য এক কফিলকে ৩৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় অতিক্রম হয়ে গেলেও তিনি কোনো ভিসা পাননি। এমনকি ভিসার জন্য দেয়া টাকাও ফেরত পাননি। এমন পরিস্থিতিতে দিশাহারা হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। এমনই এক পরিস্থিতিতে রহিমা বেগম জিনের বাদশা তান্ত্রিক, শাস্ত্রিক জৈনপুরী মা ফাতেমার দরবারে সকল সমস্যার সমাধানের লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখেন। স্বামীর সমস্যা সমাধানের আশায় তিনি বিজ্ঞাপনে দেয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন। এই সুযোগে কৌশলে বিপদগ্রস্ত রহিমা বেগমকে ফাতেমার তদবিরের মাধ্যমে জিন ও পরী সাধন করে তার সকল সমস্যা সমাধান করে দেয়ার প্রলোভন দেখায়। তাদের কথা আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বিভিন্ন কণ্ঠে অঙ্গিভঙ্গি করে ফোনে বলতো তারা। তারা রহিমা বেগমকে জানায়- সৌদি কফিলকে বাধ্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কাপ সিন্দুর লাগবে। এরপরও সৌদি কফিল বাধ্য না হওয়ায় তাকে বাধ্য করার জন্য জিন-পরীকে সৌদি কফিলের কাছে পাঠাতে জিন-পরীকে পাক পবিত্র করতে হবে। এই জন্য ভূটানী গরুর ২১ কেজি দুধ দিয়ে ধুয়ে জিন-পরীকে পবিত্র করতে হবে। একইসঙ্গে রহিমা বেগমকে রত্নময়ী শ্রী আংটি পরতে হবে। আংটি জিনেরাই তার কাছে পৌঁছে দেবে, তাই জিনদের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য টাকা লাগবে। আর এই আংটি দিতে জিন-পরীদের রহিমার কাছে যেতে মানুষের রূপ ধারণ করতে হবে। সে জন্য জিন-পরীদের আগুন মোয়া শাড়ি লাগবে এবং তাতে ৩০/৪০ হাজার টাকা লাগবে। এইসব যখন দেয়া শেষ তখন আবার রহিমা বেগমকে ওই প্রতারকরা জানায়- জিনেরা আপনার কাছে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে খবিশ জিনেরা তাদের ওপর প্রসাব করে দিয়েছে। তাতে জিনেরা আটকিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে তাদের ছাড়াতে হলে পাঁঠা বলিসহ আরও অনেক কিছু করতে হবে। এমন বিভিন্ন সময় নানা রকমের কথা বলে বিপদগ্রস্ত গৃহবধূ রহিমা বেগমের কাছ থেকে ধাপে ধাপে প্রতারণার মাধ্যমে ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। আর যখনই টাকা দিতে গড়িমসি করতো রহিমা তখনই তাকে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা জিন-পরীর বিভৎস ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখানো হতো। একইসঙ্গে এই সব কথা কাউকে বললে সন্তানের রক্তবমি হয়ে মারা যাবে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মারাত্মক ক্ষতিসহ অঙ্গহানি হবে বলেও ভয় দেখাতো চক্রটি। এভাবেই বিপদগ্রস্তের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে বহু পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেছে চক্রটি। রহিমা বেগম যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন তখন আর কেউ যেন আর এমন প্রতারণার শিকার না হয় সেই কথা ভেবে অজ্ঞাতনামা আসামি করে গত ২২শে এপ্রিল তেজগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার তদন্ত শুরু করে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। সবশেষ গত ১৮ই মে ভোলা সদর, লালমোহন, তজুমুদ্দীন, বোরহানউদ্দিন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চৌমুহনী বাজার থেকে মো. রাকিব (২০), মো. রাকিব মোল্লা (২৯), মো. আলাউদ্দিনকে (২৬) আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে এই প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ৪টি মোবাইল, ৩টি লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ভিডিও, আসামিদের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের কথা বলার ভয়েস রেকর্ড ১০টি, ৭টি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছবি জব্দ করা হয়। গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানান পিবিআই’র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. এনায়েত হোসেন মান্নান।
তিনি বলেন, অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করে ভুয়া সিম তুলে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন ও টাকা নিয়েছে মর্মে স্বীকার করে। তদন্তে বিকাশ স্টেটমেন্ট পাওয়া গিয়েছে। তাদের জবানবন্দিতে ভয়াবহ, লোমহর্ষক, চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের সঙ্গে প্রতারণার কাজে আরও একাধিক আসামি জড়িত রয়েছেন। তারা গত ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ৭ বছর প্রতারণা করে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের টাকার লেনদেনের ৫টি বিকাশ অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে এই পুলিশ কর্মকর্তা।