দেশ বিদেশ
প্লাস্টিক পলিথিনে ঢাকার তিন খালের মরণদশা!
শরিফ রুবেল
২৬ মে ২০২৫, সোমবার
ধোলাইপাড় খাল। এক কিলোমিটার খালের দুই পাশে অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ মাদ্রাসা ও হাট-বাজার। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বাসাবাড়ির শত শত সুয়ারেজ লাইন গিয়ে ঠেকেছে এই খালে। আশপাশের ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পয়ঃনিষ্কাশনের একমাত্র অবলম্বন এই ধোলাইপাড় খাল। প্রতিদিন এই খাল দিয়ে হাজার হাজার ঘনফুট ময়লা পানি গিয়ে পড়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে। তবে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা কোনো খাল নাকি ময়লার ভাগাড়। প্লাস্টিক, পলিথিন, আবাসিক বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনায় একসময়ের জীবিত খালটির এখন মরণদশা। অথচ ২৫ থেকে ৩০ বছর আগেও খালটি ১২০ ফুট লম্বা ছিল। ছিল পানিপ্রবাহও। তবে, এক যুগের নজিরবিহীন দখল আর দূষণে প্রবাহিত খালটি ১০ ফুটে গিয়ে ঠেকেছে। স্থানীয়রা বলছে, একসময় এই খালে জোয়ার-ভাটা হতো, মাছেও ভরপুর ছিল। নৌকাও চলতো। তা এখন ইতিহাস মাত্র। বর্তমানে খালটি দেখতে একটি খোলা ড্রেনের মতো। দু’পাশের রাস্তার অধিকাংশই খাল ভরাট করে তৈরি করা হয়। দখলদাররা কেউ কেউ কাঁচা-পাকা দালানকোঠা, ঘরবাড়ি এমনকি বহুতল ভবনও গড়ে তুলেছে।
সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আশপাশের বাসাবাড়ি থেকে ড্রাম ভরে ময়লা-আবর্জনা এনে খালে ফেলা হচ্ছে। এমনকি ময়লা সংগ্রহ করা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও গাড়ি করে ময়লা এনে খালে ফেলছেন। এতে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালের পাড়ের হাট-বাজার থেকেও ময়লা এনে ফেলা হচ্ছে। খালের পানিতে ময়লার স্তূপ জমে আছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনে খালের পানি দেখা যায় না। মনে হয় শুকনো কোনো ময়লার ভাগাড়। এক কিলোমিটার খালের কিছু জায়গায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে আছে। খালের পানিতে প্রচুর মশা মাছির স্তূপ পড়ে আছে। দু’পাশের রাস্তা দিয়ে মানুষ নাক চেপে হাঁটছেন। কথা হয় খালের পাড়ের ভ্রাম্যমাণ ফল ব্যবসায়ী হামিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি ২০ বছর ধরে ধোলাইপাড় এলাকায় আছি। আগে খালটি অনেক বড় ছিল। এখন খালের জায়গা দখল করে দু’পাশে রাস্তা বানানো হয়েছে। আগে পানি জমে থাকতো না। ড্রেনের পানি খালে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বুড়িগঙ্গায় চলে যেতো। এখন ময়লা জমে থাকায় পানি বের হতে পারে না। আর শত শত মানুষ প্রতিদিন খালের ভেতর ময়লা ফেলে। ভারী ময়লা পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু প্লাস্টিক ভেসে আছে। সিটি করপোরেশনের লোকজনও এখানে ময়লা ফেলে। তবে কখনো খালটি পরিষ্কার করতে দেখিনি। এটা এখন একটি মৃত খাল। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
শুধু ধোলাইপাড় খাল নয়, একই অবস্থা মোহাম্মদপুর রামচন্দ্রপুর খালেরও। মোহাম্মদপুর বছিলা লাউতলা থেকে খালটি শুরু হয়েছে। সেখান থেকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং হয়ে শেখেরটেকের পেছন দিয়ে তুরাগ নদে গিয়ে পড়েছে। একসময়ের প্রশস্ত খালটি এখন দখল-দূষণে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। সিএস খতিয়ান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খালটির প্রায় অর্ধেকই এখন দখলদারের কবলে। প্লাস্টিক, পলিথিন বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে খালটি। পানির প্রবাহ বন্ধ থাকায় এটি এখন মশার প্রজননক্ষেত্র। খালের দুই পাড়ে মোহাম্মদিয়া হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, আকাশনীলা হাউজিং, মোহাম্মদিয়া হোমস সহ বেশ কিছু বস্তি। প্রতিদিন অসংখ্য ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে খালটির অনেকাংশই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই খালটি মোহাম্মদপুর এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, খালের বিভিন্ন অংশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। খালের আশপাশে থাকা বাসিন্দারা নিয়মিত ময়লা আবর্জনা ফেলছে। এতে করে খালের গভীরতা কমে গেছে। খালের দুই পাশে বিভিন্ন রকমের আগাছা জন্মেছে। মানুষ চলাচলের কোনো সুব্যবস্থা নেই। খালের পাশে থাকা গরুর খামার থেকেও বর্জ্য ফেলতে দেখা গেছে। নবোদয় হাউজিং এলাকায় খালের উপর ব্রিজ দিয়ে গাড়ির ওয়ার্কশপ করা হয়েছে। প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিনের স্তূপ জমে আছে। খালের পানি স্থির থাকে। পানিপ্রবাহ নেই।
ময়লা-আবর্জনায় কিছু কিছু অংশ ভরাট হয়ে গেছে। রামচন্দ্রপুর খালে চন্দ্রিমা মডেল টাউনের পাশ দিয়ে খালটির কিছু অংশ ময়লা-আবর্জনা ও মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। বছিলা স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কে অবস্থিত মসজিদ ও ইসলাহুল মহিলা মাদ্রাসার পেছনের খালেরও একই চিত্র। এসব জায়গায় স্থানীয় লোকজন সবজি চাষ করছেন। এ ছাড়া বছিলা গার্ডেন সিটি অংশে আধা কিলোমিটারের বেশি এলাকায় খালের মধ্যে ইটের গাঁথুনি দিয়ে দেয়াল বানানো হয়েছে। এর মধ্যে বালু ফেলে ভরাটের কাজ চলছে। খালের যে অংশে এভাবে ইটের দেয়াল বানিয়ে বালু ফেলা হচ্ছে, এর প্রায় ২০ থেকে ২৫ ফুট উজানে খালের সীমানা খুঁটি দেখা গেছে। একই অবস্থা কেরানীগঞ্জের দুঃখ বলে খ্যাত শুভাঢ্যা খালেরও। প্রায় ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই খাল মরে গেছে অনেক আগেই। একসময় শুভাঢ্যা খাল ছিল প্রাণবন্ত জলপথ। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত খালটি দখল ও দূষণে তার অস্তিত্বই হারাতে বসেছে। বেশ কয়েকবার খালটি উদ্ধার ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা টেকসই হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় খালটিতে নৌকা চলতো, মাছ ধরা যেতো, আশপাশের কৃষি জমিতে খালের পানি ব্যবহার করা হতো। এখন খালের প্রায় পুরোটাই দখল, প্লাস্টিক বর্জ্য ও পলিথিনে ভরা। কিছু জায়গায় খাল এমনভাবে ভরাট হয়েছে যে হেঁটে পার হওয়া যায়। অপচনশীল প্লাস্টিক আর পলিথিন বর্জ্যে ঢেকে গেছে শুভাঢ্যা খাল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, খালের পাড়ের উঁচু আবাসিক ভবনগুলোর বাসিন্দারা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে গৃহস্থালি আবর্জনা জানালা দিয়ে খালে ফেলে দেন। এতে খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, একক ব্যবহারের প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং বিপণন আইনে নিষিদ্ধ হলেও তা কার্যকর করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় নয়। এলাকার বাসিন্দা উৎপল বড়ুয়া বলেন, সরকার ঘোষণা করেছিল ১লা নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারে পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ হবে। কিন্তু এই ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সক্রিয় ভূমিকা নেই। মানুষ কাঁচাবাজার থেকে পলিথিন ব্যাগে শাকসবজি ও মাছ কিনে আনে এবং সেই ব্যাগসহ সবজি ও মাছের বর্জ্য খালে ফেলে দেয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর কালীগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে রাজেন্দ্রপুর বাজার এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে খালটি। ভূমিদস্যুদের দখল ও স্থানীয় লোকজনের ফেলা ময়লা-আর্বজনায় ইতিমধ্যে খালটির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। ঝাউবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ সাত্তার হোসেন বলেন, ছোটবেলায় এই খালে গোসল করেছি, খালের পানি পান করেছি। শ্যামবাজার থেকে মালামাল নিয়ে নৌকাযোগে সরাসরি গোলামবাজার ঘাটে আসতাম। এখন আর সেই সুযোগ নেই। খালটি ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে। তিনি বলেন, পরিবেশ ও এলাকাবাসীর স্বার্থে সরকারের উচিত- খালটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।